একটি জনু (generation) থেকে পরবর্তী জনুগুলোতে জীবের বৈশিষ্ট্যাবলি সঞ্চারিত হয়। যে প্রক্রিয়ায় পিতামাতার আকার, আকৃতি, চেহারা, দেহের গঠন-প্রকৃতি, শারীরবৃত্ত, আচরণ ইত্যাদি নানাবিধ বৈশিষ্ট্য বংশানুক্রমিকভাবে তাদের সন্তান-সন্তান দেহে সঞ্চারিত হয় তাকে বংশগতি (heredity) বলে। আর এক প্রজাতি থেকে দীর্ঘ দিন ধরে অত্যন্ত ধীর গতিতে বিবর্তন-এর ফলে নতুন প্রজাতির আবির্ভাব হয়।
জীনতত্ত্বঃ জীববিজ্ঞানের যে শাখায় জিনের গঠন, কাজ, বংশপরম্পরায় সঞ্চারণের ধরণ ও ফলাফল সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয় তাকে বংশগতিবিদ্যা বা জিনতত্ত্ব বা জেনেটিক্স (Genetics) বলে)। উইলিয়াম বেটসন (William Bateson, 1861–1926) ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম Genetics শব্দ প্রচলন করেন।
জিনতত্ত্বের জনক হিসেবে স্বীকৃত গ্রেগর ইয়োহান মেন্ডেল (Gregor Johann Mendel, 1822–1884) ছিলেন বর্তমান চেক প্রজাতন্ত্রবাসী একজন ধর্মযাজক। দীর্ঘ সাত বছর তিনি বিভিন্ন ধরনের মটর শুঁটি (Pea, Pisum sativum) গাছের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে বংশগতি সম্পর্কিত দুরকম ধারণা আহরণ করেন। এ ধারণাসহ তাঁরনিবন্ধ Experiments in Plant Hybridization (উদ্ভিদ সংকরায়ণের পরীক্ষা), ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে Proceedings of the Natural History Society in Brünn নামক জার্নালে প্রকাশিত হয় কিন্তু নিবন্ধটি মেন্ডেলের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লোকচক্ষুর অগোচরেই রয়ে যায়। ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি মেন্ডেল মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর ১৬ বছর পর অর্থাৎ ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে তিন ভিন্ন দেশের তিন বিজ্ঞানী পৃথকভাবে কিন্তু একই সময়ে মেন্ডেলের গবেষণার ফলাফল পুনরাবিষ্কার করেন। বিজ্ঞানীরা হলেন :
নেদারল্যান্ডসের উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিউগো ডে ত্রিস (Hugo de Vrics, 1848–1935),
জার্মানির উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক কার্ল করেন্স (Carl Correns, 1864–1933) এবং অস্ট্রিয়ার কৃষিবিজ্ঞানী এরিক শ্চেমেক (Erich Tschermak, 1871-1962)।
আশ্চর্যের বিষয় হলো এ বিজ্ঞানীরা তাঁদের সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ করেই মেন্ডেলের গবেষণা সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন। এভাবে মেন্ডেলের গবেষণার মাধ্যমে বংশগতির মৌলিক সূত্রের আবিষ্কার ও প্রকাশের মাধ্যমে যে ভিত্তি রচিত হয় তার উপর নির্ভর করে জীববিজ্ঞানে বংশগতিবিদ্যা বা জিনতত্ত্ব নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখার বিকাশ ঘটে । কারণে মেন্ডেলকে বংশগতিবিদ্যার জনক (Father of Genetics) বলে অভিহিত করা হয় ।
হেটারোজাইগাস
হেটেরোজায়গাস
বেকক্রস
টেস্টক্রস
মেন্ডেলিয়ান ইনহেরিট্যান্স (Mendelian Inheritance):
মেন্ডেল বিপরীত বৈশিষ্ট্য (alternative character) যুক্ত দুধরনের মটরশুঁটি গাছ (Pisum sativum) নিয়ে তাঁর পরীক্ষা শুরু করেছিলেন। এক ধরনের উদ্ভিদ ছিল লম্বা (tall), অন্য শ্রেণির উদ্ভিদ ছিল খাটো (dwarf)। পরীক্ষা শুরু করার আগে তিনি মটরশুঁটি গাছের বিশুদ্ধতা পর্যবেক্ষণ করেন। এরপর শুদ্ধ লক্ষণযুক্ত হোমোজাইগাস) একটি লম্বা উদ্ভিদের সঙ্গে শুদ্ধ লক্ষণযুক্ত একটি খাটো উদ্ভিদের কৃত্রিম পরাগসংযোগ ঘটান। লম্বা উদ্ভিদের পরাগরেণু (pollen) নিয়ে খাটো উদ্ভিদের গর্ভমুন্ডে স্থাপন করা হলো। পরাগসংযোগের ফলে উৎপন্ন বীজ থেকে যে সব উদ্ভিদ আবির্ভূত হলো) তা সবগুলোই লম্বা। প্রথম পরাগসংযোগের ফলে সৃষ্ট উদ্ভিদগুলোকে মেন্ডেল প্রথম বংশধর (first filial generation) বা F অনুরূপে চিহ্নিত করেন। পরে মেন্ডেল F জনুর উদ্ভিদগুলোর মধ্যে সংকরায়ন (hybridization) ঘটান। দ্বিতীয়বার পরাগসংযোগের ফলে সৃষ্ট দ্বিতীয় বংশধর (second filial generation)-এ বা F2 জনুর মোট ১০৬৪ উদ্ভিদের মধ্যে ৭৮৭টি লম্বা এবং ২৭৭টি খাটো পাওয়া গেল, অর্থাৎ লম্বা ও খাটো উদ্ভিদের অনুপাত দাঁড়ালো ৩ঃ১।
মেন্ডেলের পরীক্ষাগুলো (প্রতিক্ষেত্রে) একজোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্যযুক্ত মটরশুঁটি গাছের মধ্যেই সংঘটিত হয় এবং এ ধরনের পরীক্ষাকে মনোহাইব্রিড ক্রস (monohybrid cross) বা একলক্ষণ সংকরায়ন বলা হয়। পরবর্তীতে মেন্ডেল দুজোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্যযুক্ত মটরশুঁটি গাছ নিয়ে পরীক্ষা শুরু করেন। একটি শুদ্ধ লক্ষণযুক্ত হলুদ-গোল বীজ উৎপন্নকারী উদ্ভিদের সাথে অপর একটি শুদ্ধ লক্ষণযুক্ত সবুজ-কুঞ্চিত বীজ উৎপন্নকারী উদ্ভিদের পরাগসংযোগ ঘটানোর পর দেখা গেল F, জনুর সবগুলো উদ্ভিদই হলুদ-গোল বীজ উৎপন্ন করতে সক্ষম। কিন্তু F2 জনুতে ১৬টি বংশধরের মধ্যে ৯টি হলুদ-গোল, ৩টি হলুদ-কুঞ্চিত, ৩টি সবুজ-গোল ও ১টি সবুজ-কুঞ্চিত বীজ উৎপন্নকারী উদ্ভিদ পাওয়া গেল। মেন্ডেলের এ পরীক্ষাকে দুজোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্যযুক্ত উদ্ভিদের মধ্যে সংঘটিত) ডাইহাইব্রিড ক্রস (dihybrid cross) বা ছিলক্ষণ সংকরায়না বলে।) মেন্ডেলের উপরোল্লিখিত গবেষণা ও ফলাফল সামগ্রিকভাবে মেন্ডেলিয়ান ইনহেরিট্যান্স নামে পরিচিত।
মেন্ডেল তাঁর পরীক্ষার জন্য মটরশুঁটি গাছকে নমুনা হিসেবে মনোনীত করার কারণ-
১. মটরশুঁটি গাছ একবর্ষজীবী হওয়ায় অতি সহজেই বাগানের জমিতে ও টবে ফলানো যায়।
২. মটরশুঁটি গাছের প্রতিটি জনুর আয়ুষ্কাল স্বল্প হওয়ায় খুব কম সময়ের মধ্যেই সংকরায়ন পরীক্ষার ফল পাওয়া
৩. ফুলগুলো আকারে বড় হওয়ায় মটরশুঁটি গাছে অতিসহজেই সংকরায়ন ঘটানো যায়। যায়।
৪. মটরশুঁটি গাছে একাধিক সুস্পষ্ট তুলনামূলক বিপরীত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
৫. এ গাছের ফুল উভলিঙ্গ হওয়ায় সহজেই স্বপরাগায়ন ঘটানো যায়। ৬. সংকরায়ণে সৃষ্ট বংশধরগুলো উর্বর (fertile) প্রকৃতির হওয়ায় নিয়মিত বংশবৃদ্ধি করতে পারে।
জিনতত্ত্ব ব্যবহৃত শব্দের ব্যাখ্যাঃ
১. ফ্যাক্টর (Factor) বা জিন (Gene) : DNA অণুর একটি খন্ডাংশ যা জীবের বংশগতির মৌলিক ভৌত ও কার্ষিক একক এবং বংশ থেকে বংশান্তরে জীবের বৈশিষ্ট্য বহন করে।
২. লোকাস (Locus) : ক্রোমোজোমে জিনের নির্দিষ্ট স্থান-এর নাম লোকাস। একটি নির্দিষ্ট জিনের অ্যালিলগুলো সমসংস্থ ক্রোমোজোমের একই লোকাসে অবস্থান করে।
৩. অ্যালিল বা অ্যালিলোমর (Allele or Allelomorph) : সমসংস্থ (homologous) ক্রোমোজোম জোড়ের নির্দিষ্ট লোকাসে অবস্থানকারী নির্দিষ্ট জিন-জোড়ার একটিকে অপরটির অ্যালিল বলে। অ্যালিলদুটি একই ধর্মী (যেমন—TT) অথবা একে অপরের বিপরীত ধর্মী (যেমন—Tt) হতে পারে। যখন দুটি বিপরীতধর্মী অ্যালিল থাকে তখন একটিকে প্রকট অ্যালিল (অর্থাৎ T), অন্যটিকে প্রচ্ছন্ন অ্যালিল (t) বলে।
৪. হোমোজাইগাস (Homozygous) : কোনো জীবে একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী অ্যালিলদুটি সমপ্রকৃতির হলে, তাকে হোমোজাইগাস বলে। যেমন-BB= কালো পশম, bb= বাদামী পশম ইত্যাদি।
৫. হেটারোজাইগাস (Heterozygous) : কোনো জীবে একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী অ্যালিলদুটি অসমপ্রকৃতির হলে, তাকে হেটারোজাইগাস জীব বলে। যেমন T এবং t অর্থাৎ Tt-ধারী জীবটি লম্বা হলেও তা হেটারোজাইগাস।
৬. প্রকট বৈশিষ্ট্য (Dominant character) : একজোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হোমোজাইগাস জীবে (TT এবং tt) সংকরায়ন ঘটালে F1 জনুতে সৃষ্ট হেটারোজাইগাস জীবে যে বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়, তাকে প্রকট বৈশিষ্ট্য বলে। যেমন: F 1 জনুর মটরগাছে লম্বা ও খাটো উভয় ধরনের লক্ষণের জন্যে একটি করে জিন থাকলেও (Tt) শুধুমাত্র লম্বা বৈশিষ্ট্যই প্রকাশিত হয়। অতএব মটরগাছে লম্বা বৈশিষ্ট্যটি প্রকট।
৭. প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য (Recessive character) : হেটারোজাইগাস জীবে দুটি বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যের উপাদান একত্রে থাকলেও একটিমাত্র বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়, অন্যটি অপ্রকাশিত থাকে। জীবের অপ্রকাশিত বৈশিষ্ট্যকে প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য বলে। যেমন- F 1 জনুর মটরগাছে লম্বা ও খাটো উভয় ধরনের বৈশিষ্ট্যের জন্য একটি করে জিন থাকলেও (Tt) শুধুমাত্র লম্বা বৈশিষ্ট্যই প্রকাশিত হয়। অতএব মটরগাছে খাটো বৈশিষ্ট্যটি প্রচ্ছন্ন।
৮. ফিনোটাইপ (Phenotype) : জিনোটাইপ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জীবের বাহ্যিক লক্ষণকে ফিনোটাইপ বলে। এটি জীবের আকার, আকৃতি, বর্ণ প্রভৃতি প্রকাশ করে। সদৃশ ফিনোটাইপধারী দুটি জীবের জিনোটাইপ একই রকম বা ভিন্ন হতে পারে। যেমন-বিশুদ্ধ লক্ষণযুক্ত লম্বা ও খাটো মটর গাছের মধ্যে পরাগসংযোগ ঘটালে F 1 জনুতে সবগুলো উদ্ভিদই লম্বা আকৃতির হয় যদিও এদের মধ্যে দুধরনের ফ্যাকটরই (Tt) থাকে। এখানে ফিনোটাইপ হলো লম্বা।
৯. জিনোটাইপ (Genotype) : কোনো জীবের লক্ষণ নিয়ন্ত্রণকারী জিন যুগলের গঠনকে জিনোটাইপ বলে। একটি জীবের জিনোটাইপ তার পূর্ব বা উত্তর পুরুষ থেকে জানা যায়। সদৃশ জিনোটাইপধারী জীবেরা যদি একই পরিবেশে বাস করে তাহলে ওদের ফিনোটাইপও সদৃশ হবে। একটি লম্বা গাছের জিনোটাইপ হতে পারে TT বা Tt আর খাটো গাছের জিনোটাইপ হবে tt।
১০. প্যারেন্টাল জেনারেশন ও অপত্য বংশ (Parental generation & Filial generation) : কোন ক্রসে ব্যবহৃত পিতা-মাতাকে “প্যারেন্টাল জেনারেশন” বা P 1 এবং উৎপন্ন সন্তান-সন্ততিকে প্রথম অপত্য বংশ বা F 1 জনু বলে। আবার F 1 সন্তান-সন্ততির মধ্যে ক্রস করলে উৎপন্ন সন্তান-সন্ততিকে দ্বিতীয় অপত্য বংশ বা F 1 জনু বলে।
১১. একসংকর বা মনোহাইব্রিড ক্রস (Monohybrid cross) : জীবের একজোড়া বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যের উপর দৃষ্টি রেখে যে সংকরায়ন বা ক্রস ঘটানো হয়, তাকে একসংকর ক্রস বা মনোহাইব্রিড ক্রস বলে। যেমন-কালো ও বাদামী বর্ণের গিনিপিগের মধ্যে ক্রস। মনোহাইব্রিড ক্রসে ২য় বংশধরে (F 2 জনু) প্রকট ও প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্যের অনুপাত সাধারণত ৩ : ১ হয়। মেন্ডেল তাঁর প্রথম সূত্রটি একসংকর ক্রসের উপর ভিত্তি করেই প্রণয়ন করেছিলেন।
১২. দ্বিসংকর বা ডাইহাইব্রিড ক্রস (Dihybrid cross) : জীবের দুজোড়া বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যের উপর দৃষ্টি রেখে সংকরায়ন বা ক্রস। যেমন: কালোবৰ্ণ-ছোট লোমধারী ও বাদামীবর্ণ-লোমযুক্ত গিনিপিগের ক্রস। ডাইহাইব্রিড ক্রসে ২য় বংশধরে (F 2 জনু) জিনের স্বাধীন সঞ্চারণের ফলে সাধারণত ৯ : ৩ : ৩ : ১ অনুপাতে চার ধরনের বৈশিষ্ট্যসমন্বিত সন্ততি পাওয়া যায়।
১৩. টেস্ট ক্রস (Test cross) : F 1 বা F2 জনুর বংশধরগুলো হোমোজাইগাস না হেটারোজাইগাস তা জানার জন্য সেগুলোকে মাতৃবংশের বিশুদ্ধ প্রচ্ছন্ন লক্ষণবিশিষ্ট জীবের সাথে সংকরায়ন বা ক্রস। এভাবে এদের F 1 এবং F 2জনুর জিনোটাইপ বের করা যায়। যেমন-সংকর লম্বা মটরগাছ (Tt) এবং বিশুদ্ধ খাটো মটরগাছ (tt) এর সংকরায়ন ঘটালে এদের ফিনোটাইপিক এবং জিনোটাইপিক অনুপাত হবে ১ : ১।
১৪. ব্যাক ক্রস (Back cross) : F1 জনুর একটি হেটারোজাইগাস জীবের সাথে পিতৃ-মাতৃবংশীয় এক সদস্যের সঙ্গে সংকরায়ন।
১৫. জিনোম (Genome) : জীবের একটি জননকোষের ক্রোমোজামে বিদ্যমান জিনের সমষ্টি।
প্রকৃতপক্ষে মেন্ডেল নিজে কোনো মতবাদ প্রবর্তন করেননি। তিনি তাঁর গবেষণাপত্রে সংকরায়ন সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণের তত্ত্বীয় ও পরিসংখ্যানিক ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে কার্ল করেন্স (যিনি ১৯০০ সালে মেন্ডেলের অনুরূপ গবেষণা-ফলাফল প্রকাশ করেছিলেন) মেন্ডেলের আবিষ্কারকে বংশগতির মৌলিক দুটি সূত্র হিসেবে উপস্থাপনের যোগ্য বলে প্রচার করেন । যেহেতু সূত্রদুটি মেন্ডেলের গবেষণার উপর ভিত্তি করে রচিত, তাই সূত্রদুটিকে মেন্ডেল-এর সূত্র নামে অভিহিত করা হয় । নিচে মেন্ডেল-এর সূত্র দুটি ব্যাখ্যা করা হলো।
মেন্ডেলের প্রথম সূত্র বা পৃথকীকরণ সূত্র (Law of Segregation) সূত্র : সংকর (hybrid) জীবে বিপরীত বৈশিষ্ট্যের ফ্যাক্টরগুলো (জিনগুলো) মিশ্রিত বা পরিবর্তিত না হয়ে পাশাপাশি অবস্থান করে এবং জননকোষ সৃষ্টির সময় পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যায়। জিনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা : ধরা যাক, গিনিপিগে কালো বর্ণের জন্য দায়ী জিন = B এবং বাদামী বর্ণের জন্য দায়ী জিন= b; F1 জনু = প্রথম বংশধর; F2 জনু = দ্বিতীয় বংশধর ।
একটি হোমোজাইগাস বা বিশুদ্ধ কালো (BB) বর্ণের গিনিপিগের সাথে অপর একটি বিশুদ্ধ বাদামী (bb) বর্ণের গিনিপিগের সংকরায়ণ ঘটালে F, জনুতে সকল অপত্য গিনিপিগের বর্ণই হবে কালো (Bb) কারণ, কালো বর্ণের অ্যালিল (B) বাদামী বর্ণের অ্যালিল (b)-এর উপর প্রকট গুণসম্পন্ন। উভয় জিন দীর্ঘকাল একসঙ্গে থাকলেও বিনষ্ট বা একীভূত হয়ে যায় না বরং স্বকীয়তা বজায় রেখে অক্ষুন্ন থাকে।
F2 জনুতে উৎপন্ন অপত্য গিনিপিগের মধ্যে ৩টি কালো এবং ১টি বাদামী বর্ণের গিনিপিগের সৃষ্টি হয়, অর্থাৎ ফিনোটাইপের ভিত্তিতে F2 জনুতে গিনিপিগের কালো ও বাদামী বর্ণের অনুপাত হয় যথাক্রমে ৩:১
F2 জনুর সদস্যদের জিনোটাইপ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে ৩টি প্রকট বৈশিষ্ট্যধারী (কালো) গিনিপিগের মধ্যে মাত্র ১টি হোমোজাইগাস (BB), বাকি দুটি হেটারোজাইগাস (Bb)। যে প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্যটি (বাদামী) F জনুতে অবদমিত ছিল, F2 জনুতে তার পুনরাবির্ভাব ঘটেছে (bb)। অনুরূপভাবে, যে শুদ্ধ প্রকট বৈশিষ্ট্য (BB) F | জনুতে অনুপস্থিত ছিল, সেটিও F2 জনুতে ফিরে এসেছে। এ থেকেই প্রমাণ হয় যে প্রথম জনুতে B ও b একসঙ্গে থাকলেও পরস্পরের স্বকীয়তা বিনষ্ট হয়নি বরং গ্যামেট সৃষ্টির সময় পৃথক হয়ে গেছে।
মেন্ডেলের দ্বিতীয় সূত্র বা স্বাধীনভাবে মিলনের সূত্র (Law of Independent Assortment) সূত্র : দুই বা ততোধিক জোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সংকরায়ণ ঘটালে প্রথম বংশধরে (F1) কেবল প্রকট
বৈশিষ্ট্যগুলোই প্রকাশিত হবে, কিন্তু জননকোষ সৃষ্টির সময় বৈশিষ্ট্যগুলো জোড়া ভেঙ্গে পরস্পর থেকে স্বতন্ত্র বা স্বাধীনভাবে বিন্যস্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জননকোষে প্রবেশ করবে।
ব্যাখ্যা : এ সূত্র প্রমাণের জন্য মেন্ডেল দুজোড়া বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন উদ্ভিদের মধ্যে পরাগসংযোগ ঘটান। দুই জোড়া বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যের দিকে দৃষ্টি রেখে যে সংকরায়ণ (ক্রস) ঘটানো হয়, তাকে দ্বিলক্ষণ সংকরায়ন বা ডাইহাইব্রিড ক্রস (dihybrid cross) বলে।
এমন দুটি শুদ্ধ লক্ষণযুক্ত (হোমোজাইগাস) মটরশুঁটি গাছ (Pisum sativum) নেওয়া হলো যার একটি গোল ও হলুদ বর্ণের বীজ এবং অন্যটি কুঞ্চিত ও সবুজ বর্ণের বীজ উৎপাদনে সক্ষম ।
ধরা যাক, বীজের গোল লক্ষণের প্রতীক R, কুঞ্চিত লক্ষণের প্রতীক r, হলুদ লক্ষণের প্রতীক Y=বড় অক্ষরের), সবুজ লক্ষণের প্রতীক = y (ছোট অক্ষরের), প্রথম বংশধর = F1, জনু, দ্বিতীয় বংশধর= F2 জনু।
মেন্ডেল-এর মতে, প্রত্যেক বৈশিষ্ট্যের জন্য দুটি করে ফ্যাক্টর (জিন) দায়ী। অতএব, গোল ও হলুদ বর্ণের বীজযুক্ত উদ্ভিদের জিনোটাইপ হবে RRYY এবং কুঞ্চিত ও সবুজ বর্ণের বীজযুক্ত উদ্ভিদের জিনোটাইপ হবে rryy.
ফলাফলে অনুপাত হবে ৯:৩:৩:১।
মেণ্ডেল তাঁর সংকরায়ণ পরীক্ষার ফল থেকে বুঝতে পারেন যে কোনো জীবের প্রতিটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য একটি উপাদান দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। এ উপাদান জীবদেহে জোড়ায় জোড়ায় অবস্থান করে এবং হ্যাপ্লয়েড গ্যামেট গঠনকালে ঐ উপাদান সংখ্যায় অর্ধেক হয়ে যায়। কিন্তু উপাদানটি কী, গ্যামেটের কোথায় এটি অবস্থিত এবং এসব উপাদান কীভাবে বংশপরস্পরায় বৈশিষ্ট্যগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে—এসব বিষয়ে মেডেল অবগত ছিলেন না।
১৯০০ সালে মেণ্ডেল তত্ত্বের পুনরাবিষ্কারের পর ক্রোমোজোম ও মেডেলের উপাদানের মধ্যে বেশ কিছু মিল দেখতে পাওয়া যায়। প্রত্যেকটি ক্রোমোজোমের আকৃতি ও দৈর্ঘ্য আলাদা আলাদা এবং দেহকোষে জোড়ায় জোড়ায় থাকে। জোড়ার একটি পিতার কাছ থেকে, অপরটি মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। অর্থাৎ মানুষের দেহকোষের ৪৬টি ক্রোমোজোমের ২৩টি আসে পিতার কাছ থেকে, বাকি ২৩টি মায়ের কাছ থেকে। ২৩টি করে ক্রোমোজোম শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মধ্যে থাকে, দুটি কোষের মিলনে ৪৬টি ক্রোমোজোম নিয়ে জাইগোট কোষের সৃষ্টি হয়। মেন্ডেল একটি বৈশিষ্ট্যের জন্য একজোড়া উপাদানের কথা বলেছিলেন, যার একটি পিতা ও একটি মাতার কাছ থেকে আসে, যেমনটি ক্রোমোজোমের ক্ষেত্রেও ঘটে থাকে
১৯০২ সালে বিজ্ঞানী সাটন (S.W. Sutton) ও বোভেরি (T. Bovery) পৃথকভাবে ক্রোমোজোম ও মেণ্ডেলের উপাদানের মধ্যে মিলের কথাটি সুস্পষ্ট উল্লেখ করেন। এ নিয়ে প্রায় এক যুগ ধরে বিভিন্ন জীব-জন্তুর উপর গবেষণা চলেছে। পরে জানা গেল যে মেন্ডেলের উপাদান বা জিনের অবস্থান ক্রোমোজোমে, তাই বংশানুক্রমিক গতিপ্রকৃতির বিষয়ে ক্রোমোজোম আর উপাদানের মধ্যে এত সাদৃশ্য। গবেষণার ফলাফল থেকে তাঁরা সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে জিন ও ক্রোমোজোম অনেক দিক দিয়ে একই রকম আচরণ করে। তা ছাড়া (বংশগতি নির্ধারণের সময় জিন ও ক্রোমোজোম সমান্তরাল আচরণ প্রদর্শন করে। একেই বংশগতির ক্রোমোজোম তত্ত্ব বলা হয়। সাটন ও বোভেরি প্রবর্তিত তত্ত্বের আলোকে বংশগতির ক্রোমোজোম তত্ত্বের মূল ভিত্তি নিচে উল্লেখ করা হলো।
১. একমাত্র শুক্রাণু ও ডিম্বাণুই যেহেতু বংশপরম্পরার সেতু হিসেবে কাজ করে তাই সমস্ত বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য এগুলোর মধ্যেই বাহিত হয়।
২. জাইগোট সৃষ্টিতে যেহেতু শুক্রাণুর মস্তকে অবস্থিত নিউক্লিয়াস অংশ গ্রহণ করে, তাই ধারণা করা যায় যে জননকোষের নিউক্লিয়াসই বংশগতি পদার্থ বহন করে।
৩. নিউক্লিয়াসে ক্রোমোজোম থাকে, অতএব ক্রোমোজোমই বংশগতি পদার্থ বহন করে ।
৪. প্রত্যেকটি ক্রোমোজোম বা ক্রোমোজোম-জোড় নির্দিষ্ট জীবের পরিস্ফুটনে সুনির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করে। একটি ক্রোমোজোম বা অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত বা নষ্ট হলে জীবদেহে অঙ্গহানি ও কার্যগত অক্ষমতা দেখা দিতে পারে ।
৫. বংশগতি পদার্থের মতো ক্রোমোজোম ও জীবদেহে আজীবন ও বংশপরম্পরায় তাদের সংখ্যা, গঠন ও স্বকীয়তা বজায় রাখে। কোনোটাই হারিয়ে যায় না বা একীভূত হয় না, বরং একক-এর মতো আচরণ করে ।
৬. ডিপ্লয়েড (2n) কোষে (দেহকোষে) ক্রোমোজোম ও জিন জোড়ায় জোড়ায় অবস্থান করে ।
৭. ক্রোমোজোমে সুনির্দিষ্ট অবস্থানে (লোকাসে) জিন অবস্থান করে।
৮. মিয়োসিসের সময় সমসংস্থ ক্রোমোজোম-জোড় ও জিন স্বাধীনভাবে পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে জননকোষে প্রবেশ করে।
৯. একটি গ্যামেট একসেট ক্রোমোজোম ও অ্যালিল বহন করে।
১০. নিষেক প্রক্রিয়ায় শুক্রাণু ও ডিম্বাণু নিউক্লিয়াসের একীভবনের মাধ্যমে জাইগোট সৃষ্টির ফলে অপত্য জীবদেহে ডিপ্লয়েড ক্রোমোজোম ও জিনসংখ্যা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় ।
সমপ্রকটতা (Co-dominance): - ফলাফল ১ : ২ : ১
(সমসংস্থ ক্রোমোজোমের একই লোকাসে অবস্থিত বিপরীত বৈশিষ্ট্যের দুটি অ্যালিল হেটারোজাইগাস অবস্থায় যখন একট-প্রচ্ছন্ন সম্পর্কের পরিবর্তে উভয়েই সমানভাবে প্রকাশিত হয়, তখন জিনের এ ধরনের স্বভাবকে সমপ্রকটতা বলে) অন্যভাবে বলা যায়, সংকর জীবে যখন দুটি বিপরীতধর্মী জিনের দুটি বৈশিষ্ট্যই সমানভাবে প্রকাশিত হয় তখন তাকে অপ্রকটতা বলে। এতে মেন্ডেলিয়ান ৩ : ১ অনুপাতটি পরিবর্তিত হয়ে ১: ২ : ১ রূপে প্রকাশ পায়।
কালো ও সাদা বর্ণের আন্দালুসিয়ান মোরগ-মুরগির মধ্যে ক্রস ঘটিয়ে সমপ্রকটতা লক্ষ করা যায়। এক্ষেত্রে কালো বা পালক (BB) এবং সাদা পালক (bb)-এর মোরগ-মুরগিতে ক্রস ঘটানো হলে F। জনুর সকল মোরগ-মুরগিই কালো সাদা না হয়ে সমপ্রকটতার কারণে কালোর মাঝে সাদা ছোপযুক্ত (Bb) হয়।
মারণ জিন বা লিথাল জিন (Lethal Gene) : অনুপাত ২: ১
যেসব জিন হোমোজাইগাস অবস্থায় উপস্থিত থাকলে সংশ্লিষ্ট জীবের মৃত্যু ঘটে সেসব জিনকে লিথাল জিন বলে।
লিথাল জিনের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Lethal Gene):
১. লিথাল জিন একধরনের মিউট্যান্ট জিন (mutant gene) যা প্রকট বা প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে।
২. প্রকট লিথাল জিন হোমোজাইগাস বা হেটারোজাইগাস উভয় অবস্থায়ই জীবের মৃত্যু কিংবা আঙ্গিক বৈকল্য ঘটাতে পারে।
৩. জাইগোট বা ভ্রূণ অবস্থায় জীব মারা যায় বলে লিথান জিনের প্রভাব চোখে পড়েনা, তবে কোনো ক্ষেত্রে জীবের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে এর প্রকাশ ঘটে।
৪. লিথাল জিনের প্রভাবে ৩ : ১ অনুপাতের পরিবর্তে ২ : ১ অনুপাত প্রকাশিত হয়।
জিনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা (Genetic explanation):
ধরা যাক, ইঁদুরের গায়ের হলুদ বর্ণের লোমের জন্য দায়ী প্রকট জিন Y এবং অ্যাগাউটি বর্ণের লোমের জন্য দায়ী প্রচ্ছন্ন জিন y.
মেন্ডেলের সূত্র অনুযায়ী বিশুদ্ধ বা হোমোজাইগাস হলুদ বর্ণের ইঁদুরের জিনোটাইপ হবে YY এবং বিশুদ্ধ অ্যাগাউটি বর্ণের ইঁদুরের জিনোটাইপ হবে yy. কিন্তু প্রকৃতিতে যে সব হলুদ বর্ণের ইঁদুর পাওয়া যায় তার কোনটিই বিশুদ্ধ বা হোমোজাইগাস (YY) জিনোটাইপধারী নয়। কারণ Y জিন হোমোজাইগাস অবস্থায় লিথাল জিন হিসেবে কাজ করে ভ্রুণ অবস্থায় ইঁদুরের মৃত্যু ঘটায়। তাই প্রকৃতিতে যেসব হলুদ বর্ণের ইঁদুর পাওয়া যায় তারা সবাই হেটারোজাইগাস অর্থাৎ সংকর (Yy) প্রকৃতির।
লিথাল জিন (Lethal Gene):
যে সব লিথাল জিনের প্রভাবে ৫০% এর বেশি জীব মারা যায় সেগুলোকে সেমিলিথাল জিন (semilethal gene) বলে। অন্যদিকে, যেসব লিথাল জিনের প্রভাবে ৫০% এর কম সংখ্যক জীব মারা যায় সেগুলোকে সাবভাইটাল জিন (subvital gene) বলে। মানুষে হিমোফিলিয়া রোগ সৃষ্টিকারী লিথাল জিন সেমিলিথাল ধরনের। ড্রসোফিলা মাছির লুপ্তপ্রায় ডানা সৃষ্টিকারী লিথাল জিন সাবভাইটাল ধরনের।
পরিপূরক জিন (Complementary Gene) - ফিনোটাইপিক অনুপাত ৯ : ৭ (ভিন্ন ভিন্ন লোকাসে অবস্থিত দুটি প্রকট জিনের উপস্থিতির কারণে যদি জীবের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। তখন জিনদুটিকে পরস্পরের পরিপুরক জিন বলে এবং এ অবস্থাকে সহপ্রকটতা বলা হয়।
Lathyrus odoratus নামক মিষ্টি মটর উদ্ভিদে সাদা ফুলবিশিষ্ট দুটি আলাদা স্ট্রেইন (strain) পাওয়া যায়। এই স্ট্রেইনদুটির মধ্যে সংকরায়ণ করলে F। জনুর সব উদ্ভিদের ফুল বেগুনি হয়। কিন্তু F2 জনুতে বেগুনি ও সাদা ফুলের অনুপাত দাঁড়ায় ৯ : ৭।
এপিস্ট্যাসিস (Epistasis)
কিছু ক্ষেত্রে দুটি পৃথক জিন জীবের একটি বৈশিষ্ট্য প্রকাশে অংশগ্রহণ করে এবং এদের একটি জিন অপর জিনের কাশকে বাধা দেয় । এভাবে, একটি জিন যখন অন্য একটি নন-অ্যালিলিক (non-allelic) জিনের কার্যকারিতা প্রকাশে বাধা দেয় তখন এ প্রক্রিয়াকে এপিস্ট্যাসিস বলে। যে জিনটি অপর জিনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশে বাধা দেয় সে জিনকে এপিস্ট্যাটিক জিন (epistatic gene), আর যে জিনটি বৈশিষ্ট্য প্রকাশে বাধা পায় সে জিনটিকে হাইপোস্ট্যাটিক জিন (hypostatic gene) বলে।
প্রকট এপিস্ট্যাসিস (Dominant Epistasis) অনুপাত ১৩ : ৩। যখন একটি প্রকট জিন অন্য একটি নন-অ্যালিলিক প্রকট জিনের কার্যকারিতা প্রকাশে বাধা দেয় তখন এ প্রক্রিয়াকে প্রকট এপিস্ট্যাসিস বলে।
১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে বেটসন (Bateson) এবং পানেট (Punnett) পরিচালিত এক পরীক্ষায় আবিষ্কৃত হয় যে সামা লেগহর্ণ (Leghorn) গোষ্ঠীর মোরগ-মুরগীতে রঙিন পালক সৃষ্টির জন্য দায়ী একটি প্রকট জিন (C) থাকে। কিন্তু এপিস্ট্যাটিক জিন (I)- এর কারণে রঙিন পালক সৃষ্টি হতে না পারায় পালকগুলো সাদা হয়। F, জনুতে সব সাদা পালক- বিশিষ্ট হলেও F2 জনুতে ১৩ : ৩ অনুপাতে সাদা ও রঙিন পালক-বিশিষ্ট মোরগ-মুরগী সৃষ্টি হয়।
জিনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যাঃ
ধরা যাক, সাদা লেগহর্ণের রঙিন পালকের জন্য দায়ী প্রকট জিন = C এবং সাদা লেগহর্ণের রঙিন পালকের বাধাদানকারী প্রকট জিন = I.
অতএব, সাদা লেগহর্ণের জিনোটাইপ CCII এবং সাদা ওয়াইনডটের জিনোটাইপ ccii. অর্থাৎ এক্ষেত্রে C হচ্ছে প্রকট হাইপোস্ট্যাটিক জিন এবং I প্রকট এপিস্ট্যাটিক জিন।
সাদা লেগহর্ণ এবং সাদা ওয়াইনডট-এর মধ্যে ক্রস ঘটিয়ে বিস্ময়কর ফলাফল লক্ষ করা গেছে। একটি সাস পালকযুক্ত লেগহর্ণ-এর সাথে সাদা পালকযুক্ত ওয়াইনডট-এর ক্রস ঘটালে প্রথম বংশধরে (F) জনু) সবগুলো শাবকই সাদা পালকযুক্ত পাওয়া যাবে।F, জনুর মোরগ-মুরগীর মধ্যে ক্রস ঘটিয়ে দেখা গেছে F2 জনুতে সাদা ও রঙিন উভয় ধরনের পাখিরই আবির্ভাব ঘটে এবং এদের অনুপাত দাঁড়ায় ১৩ : ৩।
দ্বৈত প্রচ্ছন্ন এপিস্ট্যাসিস (Duplicate Recessive Epistasis ) – অনুপাত ৯ : ৭। দুটি ভিন্ন লোকাসে অবস্থিত দুটি প্রচ্ছন্ন অ্যালিল যখন পরস্পরের (একে অপরের) প্রকট অ্যালিলকে নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য প্রকাশে বাধা দেয়, তখন তাকে দ্বৈত প্রচ্ছন্ন এপিস্ট্যাসিস বলে অর্থাৎ এক্ষেত্রে কেবল হোমোজাইগাস প্রচ্ছন্ন বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে।
মানুষে জন্মগত মুক-বধিরতা দ্বৈত প্রচ্ছন্ন এপিস্ট্যাসিসের অন্যতম উদাহরণ। দুটি ভিন্ন লোকাসে অবস্থিত এপিস্ট্যাটিক প্রচ্ছন্ন জিন এর জন্য দায়ী। এ দুটি জিনের একটি যখন হোমোজাইগাস প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে তখন অন্য প্রকট জিনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশে বাধা পায়। অর্থাৎ উল্লিখিত দুজোড়া প্রচ্ছন্ন জিনের যেকোনো একজোড়া থাকলে এবং অন্য জোড়ার প্রকট জিন থাকলেও যেকোনো ব্যক্তি জন্মগত মূকবধির (deaf-mute) হবে। এক্ষেত্রে প্রচ্ছন্ন জিন-জোড় প্রকট জিনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশে বাধা দিচ্ছে।
জিনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা : মনে করি d ও e দুটি প্রচ্ছন্ন জিন। অতএব ddEE ও DDce জিনোটাইপধারী ব্যক্তি মূকবধির হবে। এক্ষেত্রে এপিস্ট্যাটিক প্রচ্ছন্ন জিন d ও হোমোজাইগাস অবস্থায় থাকায় প্রকট হোমোজাইগাস জিন EE ও DD বৈশিষ্ট্য প্রকাশে বাধা পায়। তাই মূকবধিরতা প্রকাশ পায়।
একজন মুকবধির পুরুষের (DDee) সাথে একজন মুকবধির মহিলার (ddEE) বিয়ে হলে তাদের সকল সন্তান স্বাভাবিক বাক-শ্রবণক্ষম হবে। ঐ সন্তানদের জিনোটাইপের অনুরূপ জিনোটাইপধারী পুরুষ ও মহিলার বিয়ে হলে (কারণ) মানুষে ভাই-বোনের বিয়ে হয় না) তাদের সৃষ্ট পরবর্তী বংশধরে স্বাভাবিক বাক-শ্রবণক্ষম ও মুকবধির সন্তান ৯:৭ অনুপাতে প্রকাশ পাবে।
পলিজেনিক ইনহেরিট্যান্স (Polygenic Inheritance) বা বহুজিনীয় উত্তরাধিকারঃ
মেন্ডেলের মতে জীবের প্রতিটি বৈশিষ্ট্য একজোড়া ফ্যাক্টর বা জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু কোন নে ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ভিন্ন ভিন্ন লোকাসে অবস্থানকারী (নন-অ্যালিলিক) একাধিক জিন জীবের একটিমাত্র বেশি ক করে। যেমন-মানুষের উচ্চতা, গায়ের রং, চোখের রং, গাভির দুধ, ভুট্টা বা গমের দানার রং ইত্যাদি পরিমাণগত বৈশিষ্ট্য (quantitative traits) একাধিক জিনের সমন্বিত প্রয়োগের উপর নির্ভরশীল হয়।
ভিন্ন ভিন্ন লোকাসে অবস্থিত নন-অ্যালিলিক জিনের একটি গ্রুপ সম্মিলিতভাবে কোন জীবের একটি বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করলে তখন সেই জিন-গ্রুপকে পলিজিন (polygene) বলে। পলিজিনে নিয়ন্ত্রিত পরিমাণগত বৈশিষ্টের বংশগতিকে পলিজেনিক ইনহেরিট্যান্স বলা হয়। জিনতত্ত্ববিদ K Mather, ১৯৫৪ সালে পরিজিন নামকরণ করেন।পলিজিনের প্রভাব ক্রমবর্ধিষ্ণু (cumulative) বিধায় এরূপ চরিত্রকে মাত্রিক চরিত্র (quantitative character) বলা হয়।
পৃথিবীতে নিগ্রোদের মতো কুচকুচে কালো থেকে শুরু করে ককেশীয়দের মতো ধবধবে ফর্সা তথা জেতার পর্যন্ত নানা প্রকার গায়ের বর্ণবিশিষ্ট মানুষ দেখা যায়। নিগ্রো ও শেতাঙ্গের মধ্যে বিয়ে হলে এদের সন্তানদের গায়ের বর্ণমা অর্থাৎ মিউল্যাটো (mulatto) হয়। মিউল্যাটোদের মধ্যে বিয়ে হলে নানা ধরনের বর্ণবিশিষ্ট মানুষ দেখা যায়। নিম্নো ও শ্বেতাঙ্গ মানুষের মধ্যে বিয়ের ফলে সৃষ্ট মিউল্যাটোদের (মাঝারি বর্ণ) গায়ের বর্ণের উত্তরাধিকার পলিজেনিক উত্তরাধিকারের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
একজন নিগ্রো পুরুষের সাথে একজন শ্বেতাঙ্গ মহিলার বিয়ে হলে F, ও F2 জনুর ফলাফল হবে নিম্নরূপ।
ধরি, নিগ্রোদের বর্ণ সৃষ্টিকারী দুজোড়া জিন হচ্ছে B, B, B2 B2 এবং শ্বেতাঙ্গদের এ রকম দুই জোড় জিন by by by bg । এরূপ নিগ্রো পুরুষ ও শ্বেতাঙ্গ মহিলার মধ্যে বিয়ে হলে তাদের ক্রসের ফলে সৃষ্ট F, জনুর জিনোটাইপ হয় By by By by এবং ফিনোটাইপ হয় মিউল্যাটো বা মাঝামাঝি। F জনু মিউল্যাটো বা মাঝামাঝিদের মধ্যে ক্রস করলে Fy তে নানা রকম গায়ের রংবিশিষ্ট মানুষ দেখা যায়। এসব জিনের ক্ষেত্রে কোনো প্রকটতা (dominance) নেই। একট জিনের সংখ্যা যত বেশি হবে গায়ের রং-এর গাঢ়ত্ব তত বেড়ে যাবে।
C. B. Davenport ১৯১৩ সালে প্রমাণ করেন যে, নিগ্রো ও শ্বেতাঙ্গদের গায়ের রং-এর বংশগতি জোড়া জিন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। নিগ্রোদের দুজোড়া বর্ণ সৃষ্টিকারী জিন রয়েছে যারা মেলানিন (melanin; মেরুদন্ডী প্রাণীর হবে উপস্থিত কালো বা গাঢ় বাদামী বর্ণের রক্তাক। সঞ্চয়ে সাহায্য করে। এসব জিনগুলোতে কোনো প্রকটতা দেখা যায় না। তবে এদের সমপরিমাণ ও ক্রমবর্ধিষ্ণু প্রভাব দেখা যায়। শ্বেতকায়দের ক্ষেত্রে এ জিনগুলোর অ্যালিল মেলানিন সঞ্চারে সাহায্য করে না।
১৯০৯ সালে সুইডিস বিজ্ঞানী NilsHon Eshle গমের বীজের রং নিয়ে পরীক্ষা করার সময় লাল বীজযুক্ত গমের সাথে সাদা বীজযুক্ত গমের সংকরায়ন ঘটান। F| বংশধরে তিনি সকল গমের রং মধ্যম লাল পেলেও F2 বংশধরে ১৫টি লাল এবং ১টি সাদা শস্যযুক্ত উদ্ভিদ পান। তিনি ১৫টি লাল শস্যযুক্ত উদ্ভিদের মধ্যে লালবর্ণের গাঢ়ত্বের তারতম্য লক্ষ করেন। প্রকৃতপক্ষে এই তারতম্য বিচার করে তিনি ১ ৪ : ৬ : ৪ : ১ (গাঢ় লাল : লাল : মধ্যম লাল : ফিকে লাল : সানা) অনুপাত পেয়েছিলেন।
লিঙ্গ নির্ধারণ নীতি (Sex Determination, XX-XX, XX-XO) : ক্রোমোজোমের মাধ্যমে জীবের লিঙ্গ নির্ধারিত হয়, তাকে সেক্স ক্রোমোজোম বলে। এ ক্রোমোজোমগুলোে
সাধারনত X ও Y বা 0 ক্রোমোজোম নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
মানুষের প্রতিকোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২২ জোড়া উভয় লিঙ্গে একই রকম এবং সেগুলোকে অটোজোম (autosome) বলে। কিন্তু ২৩তম জোড়ার ক্রোমোজোম নারী ও পুরুষ সদস্যে ভিন্নতর এবং এগুলোকে হেটারোজোম ( heterosome) বা সেক্স ক্রোমোজোম (sex chromosome) বলা হয়।
নারী সদস্যে যেসব গ্যামেট সৃষ্টি হয় তাতে শুধু X ক্রোমোজোম থাকে। এ কারণে নারীকে হোমোগ্যামেটিক সের এবং এসব গ্যামেটকে হোমোগ্যামেট বলে। অন্যদিকে, (পুরুষ সদস্যে দুধরনের গ্যামেট সৃষ্টি হয়। এক ধরনের গ্যামেটে থাকে X ক্রোমোজোম, অন্যধরনের গ্যামেটে থাকে Y ক্রোমোজোম। পুরুষকে তাই হেটারোগ্যামেটিক সেক্স এবং এর গ্যামেটকে হেটারোগ্যামেট বলে। পুরুষ হেটারোগ্যামেসিস প্রক্রিয়া নিচে বর্ণিত দুই প্রকার।
১. XX-XY পদ্ধতি
(মানুষ, ড্রসোফিলা, বিভিন্ন ধরনের পতঙ্গ এবং গাঁজা, তেলাকুচা, ইপোডিয়া প্রভৃতি উদ্ভিদের লিঙ্গ নির্ধারণ):
এ পদ্ধতি অনুযায়ী স্ত্রী হোমোগ্যামেটিক বা XX এবং পুরুষ হেটারোগ্যামেটিক বা XY । স্ত্রী মাত্র এক ধরনের ডিম্বাণু (X) উৎপন্ন করে। কিন্তু পুরুষ দুরকমের শুক্রাণু (X এবং Y) গ্যামেট - সৃষ্টি করে। X-বাহী ডিম্বাণুর সাথে X-বাহী শুক্রাণুর মিলন হলে কন্যা (XX) সন্তান এবং X-বাহী ডিম্বাণুর সাথে Y-বাহী শুক্রাণুর মিলন হলে পুরুষ (XY) সন্তান জন্ম হবে।
২. XX-XY পদ্ধতি
(ফড়িং, ছারপোকা, অর্থোন্টেরা ও হেটারোন্টেরা শ্রেণির লিঙ্গ নির্ধারণ):
ফড়িং, ছারপোকা, অর্থোন্টেরা ও হেটারোটেরাভুক্ত পতঙ্গে XX-XO পদ্ধতির লিঙ্গ নির্ধারণ হয়। এখানে স্ত্রী হোমোগ্যামেটিক অর্থাৎ XX সেক্স-ক্রোমোজোমবিশিষ্ট। কিন্তু পুরুষে Y ক্রোমোজোম অনুপস্থিত। স্ত্রীর ক্রোমোজোম 2A + XX এবং পুরুষের ক্রোমোজোম ২A + XO (Y না থাকায় 'O' শূন্য লেখা হয়)। স্ত্রী হোমোগ্যামেটিক, কাজেই সমস্ত ডিম্বাণু একই ধরনের (A + X)। কিন্তু পুরুষে দুধরনের সন্তান গ্যামেট [(A + X) এবং (A + O)] উৎপন্ন হয়।
প্রথম প্রকারের শুক্রাণুর সাথে ডিম্বাণুর মিলনে স্ত্রী সন্তান (২A + XX), কিন্তু দ্বিতীয় প্রকার শুক্রাণুর সাথে ডিম্বাণুর মিলনে পুরুষ সন্তানের (২A + XO) সৃষ্টি হয়।
উদ্ভিদে সচরাচর এ ধরনের লিঙ্গ নির্ধারণ দেখা যায় না। তবে Dioscorea sinuata উদ্ভিদে এ ধরনের লিঙ্গ নির্ধারণ দেখা যায় ।
সেক্স-লিঙ্কড ডিসঅর্ডার ( Sex-linked Disorders):
প্রাণীর কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা সেক্স ক্রোমোজোমে উপস্থিত জিন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়। সেক্স ক্রোমোজোম দিয়ে নিয়ন্ত্রিত এসব বৈশিষ্ট্যকে সেক্স-লিংকড বৈশিষ্ট্য (sex linked characters) বলে। এসব বৈশিষ্ট্য সেক্স ক্রোমোজোমের সঞ্চারণ অনুযায়ী বংশানুক্রমে সঞ্চারিত হয়। সেক্স ক্রোমোজোমের মাধ্যমে সেক্স-লিঙ্কড বৈশিষ্ট্যের বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হওয়াকে সেক্স-লিংকড ইনহেরিট্যান্স (Sex linked inheritance) বলে ) মানুষে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০টি সেক্স- লিংকড জিন পাওয়া যায়। মানুষের যেসব জিন (X ও Y) নিয়ন্ত্রিত বংশগতিয় রোগ সেক্স ক্রোমোজোমের মাধ্যমে বংশ পরম্পরায় সঞ্চারিত হয় তাদের সেক্স লিঙ্কড ডিসঅর্ডার বা লিঙ্গজড়িত অস্বাভাবিকতা বলে। মানুষের X জিন নিয়ন্ত্রিত এরকম কয়েকটি রোগ হলো- লাল-সবুজ বর্ণান্ধতা (red-green colorblindness), হিমোফিলিয়া (hemophilia), ডুসেন মাসকুলার ডিস্ট্রফি (Duchenne Muscular Dystrophy)। মানুষের Y জিন নিয়ন্ত্রিত একটি বৈশিষ্ট্য হলো কানের লোম।
লাল-সবুজ বর্ণান্ধতা (Red-Green Color Blindness):
মানুষের চোখের রেটিনায় বর্ণসংবেদী কোণ কোষ (cone cell) উৎপাদনের জন্য একটি একট X লিংকড জিন প্রয়োজন। কোণ-কোষ তিন ধরনের। প্রত্যেকটি ধরন একেক বিশেষ রঙের প্রতি সংবেদনশীল। যেমন- লাল, সবুজ ও বেগুনি । এ জিনের প্রচ্ছন্ন অ্যালিল (অর্থাৎ বর্ণান্ধতার জন্য দায়ী হচ্ছে X-লিংকড় অ্যালিলের উপস্থিতি) বর্ণসংবেদী কোণ- কোষ উৎপাদনে অক্ষম। হোমোজাইগাস নারী (cc) ও পুরুষ (CY) লাল ও সবুজ বর্ণের সুস্পষ্ট পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না। অর্থাৎ নারীর ক্ষেত্রে এ জিনটি হোমোজাইগাস প্রচ্ছন্ন না হলে বর্ণান্ধতা প্রকাশ পায় না। কিন্তু পুরুষে একটি প্রচ্ছন্ন জিনই সে বৈশিষ্ট্য প্রকাশে সক্ষম ।বর্ণান্ধ পুরুষ ও স্বাভাবিক দৃষ্টিসম্পন্ন নারীর মধ্যে বিয়ে হলে F1 জনুর পুত্র বা কন্যা সবাই স্বাভাবিক দৃষ্টি সম্পন্ন হলেও কন্যাদের সবাই হবে বর্ণান্ধ জিনের বাহক এবং পরবর্তী বংশের অর্ধেকে এ জিন সঞ্চারিত হবে।
F। জনুর সন্তানদের অনুরূপ জিনোটাইপধারী (কারণ মানুষে ভাই-বোনের বিয়ে হয় না) স্বাভাবিক দৃষ্টি সম্পন্ন পুরুষের সাথে বর্ণান্ধবাহক মহিলার বিয়ে হলে ঐ মহিলার চার সন্তানের মধ্যে দুজন স্বাভাবিক দৃষ্টি সম্পন্ন কন্যা (এদের মধ্যে এক কন্যা বর্ণান্ধতার বাহক), একজন স্বাভাবিক দৃষ্টি সম্পন্ন পুত্র এবং একজন বর্ণান্ধ পুত্র জন্ম লাভ করবে।
হিমোফিলিয়া (Haemophilia):
হিমোফিলিয়া হচ্ছে বংশগতভাবে সঞ্চারণশীল বা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত একপ্রকার রক্ত তঞ্চন ঘটিত ত্রুটি বা অস্বাভাবিকতা । আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্ত তঞ্চিত হয় না এবং রক্ত ক্ষরণজনিত কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যুও হতে পারে। বর্ণান্ধতার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জীবনহানির সম্ভাবনা থাকে না কিন্তু হিমোফিলিয়ার ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি মারাও যেতে পারে । X-ক্রোমোজোমের একটি প্রচ্ছন্ন মিউট্যান্ট জিন (mutant gene; প্রাকৃতিক বা কৃত্রিমভাবে পরিব্যক্ত কোন জিন)-এর কারণে হিমোফিলিয়া হয়ে থাকে। হিমোফিলিয়া নিচেবর্ণিত দুধরনের হয়ে থাকে :
১. ক্লাসিক হিমোফিলিয়া বা হিমোফিলিয়া A ( Classic Haemophilia or Haemophilia A) : রক্ততঞ্চনের VIII নম্বর ফ্যাক্টর বা অ্যান্টিহিমোফিলিক ফ্যাক্টর (antihaemophilic factor) উৎপন্ন না হলে এ রোগটি হয়।
২. খ্রিস্টমাস ডিজিজ বা হিমোফিলিয়া B (Christmas Disease or Haemophilia B): রক্ততঞ্চনের IX নম্বর ফ্যাক্টর বা প্লাজমা থ্রম্বোপ্লাসটিন কমপোনেন্ট (plasma thromboplastin component) বা খ্রিস্টমাস ফ্যাক্টর (christmas factor) অনুপস্থিত থাকলে এ রোগটি হয়।
হিমোফিলিয়া রোগে মহিলা অপেক্ষা পুরুষরাই বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। প্রতি ১০,০০০ জন পুরুষের মধ্যে একজন হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। অধিকাংশ হিমোফিলিক ব্যক্তি হিমোফিলিয়া A রোগে আক্রান্ত হয়। সাধারণত হিমোফিলিক পুরুষ এবং মহিলারা ১৬ বছর বয়সের মধ্যেই রক্তক্ষরণের জন্য মারা যায়। X-ক্রোমোজোমে অবস্থিত স্বাভাবিক এবং হিমোফিলিয়া অ্যালিল দুটি যথাক্রমে XH এবং X"। মহিলারা তিন প্রকার জেনোটাইপ বিশিষ্ট হতে পারে-XHxH (সম্পূর্ণ স্বাভাবিক), XX (স্বাভাবিক কিন্তু বাহক) এবং xhxh (হিমোফিলিয়া আক্রান্ত)। পুরুষদের ক্ষেত্রে দুধরনের জিনোটাইপ হতে পারে, যেমন-XHY (স্বাভাবিক) এবং Xhy (হিমোফিলিয়া আক্রান্ত)। উল্লেখ্য যে ইংল্যান্ডের মহারাণী ভিক্টোরিয়ার চার কন্যার মধ্যে দুই কন্যা অ্যালিস ও বিয়াটিশ হিমোফিলিয়ার বাহক ছিলেন।
হিমোফিলিয়া আক্রান্ত পুরুষের সাথে স্বাভাবিক মহিলার বিয়ে হলে কেবল কন্যারা তা বহন করে এবং কন্যার মাধ্যমে পরবর্তীতে তার পুত্রদের মধ্যে সঞ্চালিত হবে। একজন স্বাভাবিক কিন্তু হিমোফিলিয়া বাহক মহিলার সাথে স্বাভাবিক পুরুষের বিয়ে হলে, সকল কন্যা সন্তান স্বাভাবিক হবে কিন্তু পুত্র সন্তানদের মধ্যে ৫০% হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে।
মানুষে অনেক ধরনের বংশগত রোগ দেখা যায়। এসব রোগ জেনেটিক বা জিনঘটিত রোগ-ব্যাধি নামে পরিচিত। মাসক্যুলার ডিসট্রফিও একটি জিনঘটিত রোগ। প্রধানত কক্ষাণিক ও হৃৎপেশি এবং কিছু ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে এ রোগ দেখা যায়। একটি সেক্স-লিংকড জিনের বিশৃঙ্খলার কারণে প্রধানত শিশুদেহে প্রকাশিত হাত, পা, দেহকাণ্ড, হৃৎপিন্ড ও আন্ত্রিক পেশির সঞ্চালন ও স্বাভাবিক কাজকর্মের সক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে যে দুর্বিসহ জীবনের সূত্রপাত ঘটায় সেটি হচ্ছে মাসক্যুলার ডিসট্রফি নামে এ বংশগত রোগ) অসুখটি ছেলে শিশুদের বেশি হয়।
৩০ এর বেশি ধরনের মাসক্যুলার ডিসট্রফি দেখা যায়। এর মধ্যে ৯টি হচ্ছে প্রধান বাকিগুলো দুর্লভ। দেহের আক্রান্ত ও আশ-পাশের অংশ, পেশি দুর্বলতার ধরণ, কোন বয়সে দেখা দেয় এবং রোগের গতিধারা একেক রকম। রোগের সাধারণ শারীরিক লক্ষণগুলো হচ্ছে- পেশির দুর্বলতা ও সমন্বয়ের অভাব; স্থূলতা দেখা দেওয়া; দ্রুত পেশিক্ষয়, দুর্বলতা ও পেশি অকার্যকর হওয়া; অস্থিসন্ধির কুঞ্চন; কপালের উপরে টাক হওয়া (frontal baldness); চোখে ছানি পড়া; চোখের পাতা ঝুঁকে পড়া; মানসিক অস্বাভাবিকতা; জননাঙ্গের ক্ষয়িষ্ণুতা প্রভৃতি।
মাসক্যুলার ডিস্ট্রফিযুক্ত শিশুদের বিশেষ করে বয়ঃসন্ধিকালীন শিশুদের মানসিক উঠা-নামা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তখন সর্ব শিশুর জন্যই কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার দরকার পড়ে না। নিম্নোক্ত আচরণগত বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে অভিভাবককে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে :
১. স্কুলে আচরণগত সমস্যা ও দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ দিয়ে কাজ করায় সমস্যা সম্বন্ধে শিক্ষকদের রিপোর্ট।
২. অবিভাবক বা সেবাদানকারীর উপর বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়া।
৩. মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, হাঁটতে না চাওয়া ।
৪. অসুখ সম্বন্ধে হতাশ ও আবেগতাড়িত হয়ে পড়া।
৫. ঘন ঘন বদমেজাজ দেখানো।
৬. ওষুধ খাওয়া বা ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ব্যাপার প্রতিরোধ করা বা এড়িয়ে চলা এবং
৭. নিজের বয়সী শিশুদের কর্মকান্ডে অংশ না নেওয়া বা জমায়েতে শরীক না হওয়া।
মাসকুল্যার ডিস্ট্রফি একটি দুর্লভ জিনঘটিত অসুখ। আগেই বলা হয়েছে যে তিরিশেরও বেশি ধরনের মাসক্যুলার ডিস্ট্রফি রয়েছে। এর মধ্যে ডুশেনি মাসক্যুলার ডিস্ট ফি (Duchenne Muscular Dystrophy সংক্ষেপে DMD) হচ্ছে ভয়াবহতম ডিসটফি। পঞ্চাশ হাজারে (৫০,০০০- এ) মাত্র একজনে এ রোগটি দেখা যেতে পারে। অন্য ডিস্টফিগুলো আরও দুর্লভ। মাসক্যুলার ডিস্ট্রফির সঙ্গে বোধশক্তিজনিত প্রতিক্রিয়ার সামান্য সম্পর্ক রয়েছে। কোনো শিশু যদি অনুগ্র মানসিক প্রতিবন্ধী (mild intellectual disable ) বিশিষ্ট হয় এবং মাসক্যুলার ডিস্ট্রফিতে ভোগে তাহলে সে স্বাভাবিক মানুষের মতোই লেখা-পড়া ও চাকুরি করতে পারবে, এমনকি সাধারণ মানুষের মতো যানবাহনে চলাফেরাও করতে পারবে। মাঝারি (moderate) ধরনের মানসিক প্রতিবন্ধী হলে ওসব কাজে সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। কিন্তু তীব্র (very) মানসিক প্রতিবন্ধী বিশিষ্ট মাসক্যুলার ডিসট্রফিতে ভোগে এমন শিশু অটিজম (autism)-এর দিকে ধাবিত হতে পারে।
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, জেনেটিক বিশৃঙ্খলজনিত এ রোগটির কোনো চিকিৎসা নেই। গবেষকরা মাসক্যুলার ডিসট্রফি সৃষ্টিকারী পরিব্যক্ত (mutated) জিন সংশোধনের জন্য জেনেটিক থেরাপি আবিষ্কারের উদ্দেশে গবেষণা অব্যাহত রেখেছেন। গবেষণার লক্ষ হচ্ছে অস্থিসন্ধির বিকৃতিরোধ করা, সঞ্চালন ক্ষমতা বাড়ানো এবং রোগীকে যন্ত্রণামুক্ত দীর্ঘায়ু করে তোলা। তবে বর্তমানে পেশির দুর্বলতা, আক্ষেপ, কাঠিন্য প্রভৃতি উপশমে বিভিন্ন ওষুধের প্রচলন রয়েছে (যেমন মেক্সিলেটিন, ব্যাকলোফেন, কার্বঅ্যামেজপাইন ইত্যাদি)।
X ক্রোমোজোমে অবস্থিত কোনো জিন যদি পরিব্যক্ত হয়ে অপত্য বংশে সঞ্চারিত হয় এবং রোগের প্রকাশ ঘটায় তবে সে ব্যক্তিকে X-লিংকড ব্যাধি নামে অভিহিত করা হয়। পুরুষে যেহেতু একটিমাত্র X ক্রোমোজোম থাকে তাই এসবরোগ-ব্যাধি কেবল পুরুষেই সীমাবদ্ধ থাকে। পুরুষে আরেকটি X কোমোজোমের পরিবর্তে যেহেতু Y কোমোজোম থাকে তাই মাসুক্যুলার ডিস্ট্রফির জন্য দায়ী ডিসট্রফিন জিন-এর আর কপি থাকে না।নারীদেহে দুটি X কোমোজোম (XX) থাকে। অতএব একটি X ক্রোমোজোমের জিন বিকৃত হলে অন্য X ক্রোমোজোমে অবস্থিত স্বাভাবিক জিনটি ব্যাকআপ কপি হিসেবে কাজ করে। নারী পরিব্যক্ত X-লিংকড জিন বহন করলেও তার দেহে X-লিংকড রোগের কোনো লক্ষণ প্রকাশ পাবে না, তবে ঐ নারী রোগের বাহক হিসেবে কাজ করবে এবং এই জিন তার পুত্র-সন্তানে সঞ্চারিত করবে। প্রত্যেক পুত্র সন্তান অস্বাভাবিক এ জিন উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়ার এবং রোগগ্রস্ত হওয়ার ৫০% সম্ভাবনা বহন করে। কন্যা সন্তানদের উত্তরাধিকার সূত্রে বহন এবং রোগের বাহক হিসেবে ভূমিকা পালনের সম্ভাবনা থাকবে ৫০% । X ক্রোমোজোমে স্বতঃস্ফূর্ত পরিব্যক্তি (mutation)-র ফলে পুত্র সন্তানে X লিংকড প্রচ্ছন্ন রোগের সৃষ্টি করে। মাসক্যুলার ডিসট্রফিতে জিনের ভূমিকাও দেহে প্রায় ৩ হাজার পেশি-প্রোটিন রয়েছে। প্রত্যেকটি প্রোটিন একেকটি জিন-এ রক্ষিত থাকে। কিছু পেশি-প্রোটিন পেশিতন্তুর গাঠনিক অংশ, অন্যগুলো পেশিতন্তুতে রাসায়নিক বিক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। একটি পেশি-প্রোটিন জিনে সামান্য বিকৃতিও পেশিরোগের প্রকৃতি ও ভয়াবহতাকে প্রভাবিত করে। যেমন- ডিসট্রোফিন প্রোটিন উৎপন্নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত জিনে কিছু বিকৃতি বা পরিবর্তন ঘটার ফলে তীব্র পেশি-ক্ষয়িষ্ণুতার প্রকাশ ঘটে। এ ধরনের অবস্থাকে ডুসেনি মাসক্যুলার ডিসট্রফি বলে। অন্য ক্ষেত্রে হয়তো রোগের অবস্থা তেমন ব্যাপক হয় না। আবার অন্যান্য ধরনের মাসক্যুলার ডিসট্রফিতে ডিসট্রফিন জিনে নয় বরং অন্যান্য জিনে মিউটেশন (পরিব্যক্তি) ঘটতে দেখা যায়।
লোহিত রক্তকণিকার প্লাজমামেমব্রেনে অবস্থিত বিভিন্ন অ্যান্টিজেনের উপস্থিতির ভিত্তিতে রক্তের শ্রেণিবিন্যাসকে ব্লাড গ্রুপ বলে। অস্ট্রিয়ায় জন্ম গ্রহণকারী আমেরিকান জীববিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার (Karl Landsteiner) ১৯০১ সালে মনুষ্য রক্তের শ্রেণিবিন্যাস করেন। রক্তকণিকায় কতকগুলো অ্যান্টিজেন (antigen)-এর উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির উপর নির্ভর করে বিজ্ঞানী ল্যান্ডস্টেইনার মানুষের রক্তের যে শ্রেণিবিন্যাস করেন, তা ABO ব্লাড গ্রুপ বা সংক্ষেপে ব্লাড গ্রুপ(blood group) নামে পরিচিত। অনেক সময় একে ল্যান্ডস্টেইনার-এর ব্লাড গ্রুপ (Landsteiner blood group)-ও বলে । বিজ্ঞানীদের প্রচন্ড আগ্রহের ফলে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত আরও ১৩টি ব্লাড গ্রুপ আবিষ্কৃত হয়।
মানুষের রক্তে A ও B-এই দুরকম অ্যান্টিজেন থাকতে পারে। অ্যান্টিজেন A ও B-র সাথে রক্তরসে কতকগুলো স্বতঃস্ফূত অ্যান্টিবডি রয়েছে। এগুলোকে বলে a (বা anti-A) এবং b (anti-B)। এভাবে অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডির উপস্থিতির ভিত্তিতে সমগ্র মানবজাতির রক্তকে চারটি গ্রুপে ভাগ করা যায়, যথা- A, B, AB ও O ।A ব্লাড গ্রুপে A অ্যান্টিজেন B ব্লাড গ্রুপে B অ্যান্টিজেন এবং AB ব্লাড গ্রুপে A ও B উভয় অ্যান্টিজেন থাকে । 0 ব্লাড গ্রুপে রক্তের কণিকাঝিল্লিতে কোনো অ্যান্টিজেন নেই কিন্তু রক্তরসে a ও b দুরকম অ্যান্টিবডিই থাকে। A গ্রুপের রক্তের অ্যান্টিবডি B ব্লাড গ্রুপের লোহিত কণিকাকে জমিয়ে দেয়। অনুরূপভাবে, B গ্রুপের রক্তের অ্যান্টিবডি A গ্রুপের রক্তের লোহিত কণিকাকে জমিয়ে দেয়। কিন্তু AB গ্রুপের রক্ত অন্য গ্রুপের রক্তকে জমাতে পারে না, কারণ সেখানে কোনো অ্যান্টিবডি নেই। একই কারণে O গ্রুপের রক্ত নিজের গ্রুপের রক্ত ছাড়া অন্য ৩টি গ্রুপের রক্তকে জমিয়ে দেয় । অর্থাৎ কারও দেহে O গ্রুপের রক্ত থাকলে তিনি কেবল O গ্রুপের রক্ত নিতে পারবেন কিন্তু দেওয়ার সময় সব গ্রুপকেই রক্ত দিতে পারবেন।
Rh ফ্যাক্টরঃ ১৯৪০ সালে কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার এবং উইনার (Karl Landsteiner and Wiener) রেসাস বানরের (Macaca mulatta) রক্ত খরগোসের শরীরে প্রবেশ করিয়ে খরগোসের রক্তরসে এক ধরনের অ্যান্টিবডি উৎপাদনে সক্ষম হন। এ ফলাফল থেকে বিজ্ঞানী দুজন ধারণা করেন যে, মানুষের লোহিত কণিকার ঝিল্লিতে রেসাস বানরের লোহিত কণিকার ঝিল্লির মতো এক প্রকার অ্যান্টিজেন রয়েছে। রেসাস বানরের নাম অনুসারে ঐ অ্যান্টিজেনকে রেসাস ফ্যাক্টর (Rhesus factor) বা সংক্ষেপে Rh factor বলে।
লোহিত রক্তকণিকার প্লাজমামেমব্রেনে Rh ফ্যাক্টরের উপস্থিতি-অনুপস্থিতির ভিত্তিতে রক্তের শ্রেণিবিন্যাসকে Rh ব্লাড গ্রুপ বলে। Rh ফ্যাক্টরবিশিষ্ট রক্তকে Rh+ (Rh পজিটিভ) এবং Rh ফ্যাক্টরবিহীন রক্তকে Rh (Rh নেগেটিভ) রক্ত বলে ।
বিজ্ঞানী Fisher মত প্রকাশ করেন যে, Rh ফ্যাক্টর মোট ৬টি সাধারণ অ্যান্টিজেনের সমষ্টিবিশেষ। এদের ৩ জোড়ায় ভাগ করা যায়, যেমন - C, D, d, E, e । এদের মধ্যে C, D, E হচ্ছে মেন্ডলীয় প্রকট এবং c, d, e হচ্ছে C মেন্ডেলীয় প্রচ্ছন । মানুষের লোহিত কণিকায় একসংগে ৩টি অ্যান্টিজেন থাকে কিন্তু প্রতি জোড়ার দুটি উপাদান কখনও একসাথে থাকে না, যেমন-CDE, CDe, cDE এমন সন্নিবেশ সম্ভব, CDd অসম্ভব মেন্ডেলীয় প্রকট অ্যান্টিজেন (C D. E) যে রক্তে থাকে তাকে Rh+ রক্ত বলে। যে রক্তে মেন্ডেলীয় প্রচ্ছন্ন অ্যান্টিজেন (c, d, e) থাকে তাকে Rh– রক্ত বলে।
Rh ফ্যাক্টরের কারণে সৃষ্ট সমস্যা (Problems due to Rh Factor):
১. রক্ত সঞ্চালনে জটিলতা (Complexity in Blood Transfusion) : Rh রক্তবিশিষ্ট ব্যক্তির রক্তে Rh+ বিশিষ্ট রক্ত দিলে প্রথমবার গ্রহীতার দেহে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় না, কিন্তু গ্রহীতার রক্তরসে ক্রমশ Rh+ অ্যান্টিজেনের বিপরীত অ্যান্টিবডি উৎপন্ন হবে। এই অ্যান্টিবডিকে অ্যান্টি Rh ফ্যাক্টর বলে।
গ্রহীতা যদি দ্বিতীয়বার দাতার Rh+ রক্ত গ্রহণ করে তা হলে গ্রহীতার রক্তরসের অ্যান্টি Rh ফ্যাক্টরের প্রভাবে দাতার লোহিত রক্তকণিকা জমাট বেঁধে পিন্ডে পরিণত হবে। তবে একবার সঞ্চারণের পর যদি গ্রহীতা আর ঐ রক্ত গ্রহণ না করে তা হলে ধীরে ধীরে তার রক্তে উৎপন্ন সমস্ত অ্যান্টি Rh ফ্যাক্টর নষ্ট হয়ে যায় এবং গ্রহীতা স্বাভাবিক রক্ত ফিরে পায়।
২. গর্ভধারণজনিত জটিলতা (Complexity in Pregnancy): সন্তানসম্ভবা মহিলাদের ক্ষেত্রে Rh ফ্যাক্টর খুব গুরুত্বপূর্ণ। একজন Rh (Rh নেগেটিভ) মহিলার সঙ্গে Rh+ (Rh পজিটিভ) পুরুষের বিয়ে হলে তাদের প্রথম সন্তান হবে Rh+, কারণ Rh+ একটি প্রকট বিশিষ্ট্য। ভ্রূণ অবস্থায় সন্তানের Rh+ ফ্যাক্টরযুক্ত লোহিত কণিকা অমরার মাধ্যমে মায়ের রক্তে এসে পৌঁছাবে, ফলে মায়ের রক্ত Rh হওয়ায় তার রক্তরসে অ্যান্টি Rh ফ্যাক্টর (অ্যান্টিবডি) উৎপন্ন হবে।অ্যান্টি Rh ফ্যাক্টর মায়ের রক্ত থেকে অমরার মাধ্যমে ভ্রূণের রক্তে প্রবেশ করলে ভ্রূণের লোহিত কণিকাকে ধ্বংস করে, ভ্রূণও বিনষ্ট হয় এবং গর্ভপাত ঘটে। এ অবস্থায় শিশু জীবিত থাকলেও তার দেহে প্রচন্ড রক্তাল্পতা এবং জন্মের পর জন্ডিস রোগ দেখা দেয় । এ অবস্থাকে এরিথ্রোব্লাস্টোসিস ফিটালিস ( erythroblastosis foctalis) বলে।
যেহেতু Rh বিরোধী অ্যান্টিবডি মাতৃদেহে খুব ধীরে ধীরে উৎপন্ন হয় তাই প্রথম সন্তানের কোনো ক্ষতি হয় না এবং সুস্থই জন্মায়। কিন্তু পরবর্তী গর্ভাধান থেকে বিপত্তি শুরু হয় এবং ভ্রূণ এ রোগে ভুগে মারা যায়। তাই বিয়ের আগে হবু বর-কনের রক্ত পরীক্ষা করে নেয়া উচিত এবং একই Rh ফ্যাক্টরভুক্ত (হয় Rh+ নয়তো, Rh) দম্পতি হওয়া উচিত । তবে সুখের কথা এই যে, পৃথিবীর বেশীর ভাগ অংশে Rh বৈশিষ্ট্য দুর্লভ।
কানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ককেশিয়ানদের ১৫% Rh T বৈশিষ্ট্য বহন করে। তবে যাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় তারা হচ্ছে পাইরেনীজ-এর বাস্ক (২৫-৩৫%), আফ্রিকার বার্বার এবং সাইনাই-উপদ্বীপের বেদুইন (১৮-৩০%)।
মন্থর গতিসম্পন্ন ও প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মাধ্যমে সরলদেহী জীব থেকে জটিল জীবের আবির্ভাবকে বিবর্তনবাদ বিবর্তন এর ইংরেজী Evolution শব্দটি প্রকৃত পক্ষে ল্যাটিন শব্দ 'Evolvere” অর্থ বিকশিত হওয়া উন্মুক্ত হওয়া শব্দ থেকে উৎপত্তি হয়েছে।
এম্পেডোক্লিস (Empedocles, 495-435 B.C)-কে বিবর্তনের জনক বলে অভিহিত করা হয়। যোগ্যতমের আকস্মিক সৃষ্টি এবং অযোগ্যের বিলুপ্তি সম্বন্ধে তিনি জোড়ালো ধারণা পোষণ করতেন। জেমোডিটাস উভয়েরই (Democritus, 460-357 B.C.) এ ধারণা পোষণ করতেন যে শরীরের যে কোন অঙ্গ পরিবেশের সাথে অভিযোজিত থেকে C হয়। বিখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টটল (Aristotle, 384-322 B.C)-এর মনেও এ ধারণা জন্মেছিল যে নিম্নগ্ধতার জীব কতকগুলো ধারাবাহিক নিয়মের মধ্য দিয়ে উন্নতির পথে অগ্রসর হয়েছে। অ্যারিস্টটলের পরে ফরাসি বিজ্ঞানী বুদ্ধ অভিযোজি (Buffon, 1707-1788) মত প্রকাশ করেন যে পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে বসবাসকারী জীবেরও পরিবর্তন হচ্ছে। জীবদেহে পরিবেশের প্রভাবে প্রথমে জীবদেহে সামান্য আঙ্গিক পরিবর্তন ঘটতে পারে এবং পরে ঐ পরিবর্তন বহুকাল ধরে বংশানুক্রমে পুঞ্জীভূত হয়ে ক্রমে বড় রকমের প্রভেদ সৃষ্টি করে। পরবর্তীকালে কয়েকজন বিজ্ঞানী উপযুক্ত তথ্য প্রমাণসহ বিবর্তনের কলা-কৌশল সম্বন্ধে মতবাদ প্রচার করেন। এগুলোর মধ্যে ফরাসি প্রকৃতিবিদ জ্যা ব্যাপটিস্ট ল্যামার্ক ইরের প্রকৃতিবিদ চালর্স ডারউইন, ডাচ বিজ্ঞানী ডে ত্রিস (de Vries), জার্মান বিজ্ঞানী আগস্ট ভাইজম্যান-এর মতবাদ ও সংশ্লেষ মতবাদই প্রধান
আদি ব্যঙের জীবাশ্ম
আদি সরীসৃপ জীবাশ্ম
আদি পাখির জীবাশ্ম
আদি স্তন্যপায়ী প্রাণীর জীবাশ্ম
ল্যামার্কিজম (ল্যামার্কের)- এর সূত্রসমূহ
ডডসন ১৯০৬০ খ্রিস্টাব্দে বিবর্তন সম্বন্ধে-এর বিস্তৃত ধারণাকে ৪টি সূত্রের অদীন করে ব্যাখ্যার সুবিধা করে দেন।
ক. প্রথম সূত্র-বৃদ্ধি: প্রত্যেক জীব তার জীবনকালে অন্তঃজীবনী শক্তির প্রভাবে দেহের আকার এবং অঙ্গ-প্রতঙ্গের বৃদ্ধি ঘটাতে চায়।
খ.দ্বিতীয় সূত্র- পরিবেশের প্রভাব এবং জীবের সক্রিয় প্রচেষ্টা ও আঙ্গিক পরিবর্তন: সদা পরিবর্তনশীল পরিবেশে অভিযোজনের জন্য সৃষ্ট অভাবরোধের উদ্দীপনা এবং নিরন্তর প্রচেষ্টার ফলে দেহের আঙ্গিক পরিবর্তন ঘটে।
গ. তৃতীয় সুত্র- ব্যবহার ও অব্যবহার : ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে দেহের একটি বিশেষ অঙ্গ সুগঠিত, কার্যক্ষম ও বড় হতে পারে, আবার অব্যবহার অঙ্গটি ক্রমশ ক্ষুদ্র হয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
ঘ. চতুর্থ সূত্র- অর্জিত বৈশিষ্ট্যের উত্তরাধিকার : প্রতিটি জীবরে জীবদ্দশায় অর্জিত সকল বৈশিষ্ট ভবিষ্যৎ বংশধরে সঞ্চারিত হয়।
ল্যামার্কিজমের সমালোচনা
ল্যামার্কের সমকালীন অনেকের সাময়িক স্বীকৃতি পেলেও এ মতবাদ বিজ্ঞানীমহলে অনেক কারণে সমর্থনযোগ্য হয়নি, যেমন ঃ ল্যামার্কের ব্যবহার ও অব্যবহার তত্ত্বটি সত্য নয়; কারণ, শিরা ও ধমনী ক্রমাগত ব্যবহৃত হলেও এদের আকার ও আয়তন কখনো বুদ্ধি পায় না; বারংবার ব্যবহারের ফলে কোন অঙ্গের বৃদ্ধি হয়ত হতে পারে। কিন্তু ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে কোন অঙ্গের নিষ্ক্রেয়তা কিংবা অবলুপ্তির ঘটনাও বিরল নয়; অর্জিত গুণের বংশানুক্রম সমর্থনযোগ্য নয়। লেজ কাটা কুকুরের বাচ্চা জন্মসূত্রে কখনই লেজবিহীন হয় না; অভাব বোধ ও প্রয়োজনের তাগিদে অঙ্গ সৃষ্টির ধারণা সমর্থনযোগ্য নয়। আকাশে উড়বার আকা খায় কোন মানুষের মনে পাখির মত ডানার জন্য অভাব বোধ মানুষের দেহে কখনো ডানা গজাবে না; ইন্দ্রিয় সৃষ্টির পূর্বে কোন ইন্দ্রিয়ের জন্য অভাব অনুভূত হওয়ার কথা কল্পনাও করা যায় না; ল্যামার্ক ধারণা করতেন ক্রিয়ার ফলেই কৌন অঙ্গের সৃষ্টি হয়। কিন্তু অঙ্গ না থাকলে তাঁর ক্রিয়ার প্রশ্ন অবান্তর।
চার্লস রবার্ট ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২) একজন ব্রিটিশ প্রকৃতিবিজ্ঞানী (Naturalist) ছিলেন। ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত "Origin of Species By Means of Natural Selection" নামক গ্রন্থে তিনি অভিব্যক্তি সম্পর্কে তাঁর সুচিন্তিত ও জোরালো মতবাদ প্রকাশ করেন। এ মতবাদ প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদ বা ডারউইনিজম নামেও পরিচিত। ১৮৩১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর এইচ. এম. এস. বিগল নৌজাহাজের একজন অবৈতনিক প্রকৃতিবিদ হিসেবে দক্ষিণ আটলান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগর জরীপদলের সাথে ইংল্যান্ডের ডেভেনপোর্ট থেকে যাত্রা শুরু করেন। সুদীর্ঘ পাচ বছর পর ১৮৩৫ সালের ২রা অক্টোবর বিগল ইংল্যাণ্ডে ফিরে আসে। এ সমুদ্র ভ্রমণে ডারউইন অসংখ্য জীবাশ্ম, খনিজ পদার্থ এবং পাথর সংগ্রহ করেন। প্রাকৃতিক নির্বাচনের যুক্তিযুক্ত বিশ্লেষণ ও প্রমাণাদিসহ ১৮৫৯ সালের ২৪শে নভেম্বর “On the Origin of Species by Means of Natural Selection" শিরোনামে ভারউইনের বিশ্ব কাঁপানো, যুগান্ত সৃষ্টিকারী গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
ডারউইনবাদ বা ডারউইনিজম
১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ডারউইন ও ওয়ালেস জৈব বিবর্তন সম্বন্ধে যে বক্তব্য রেখেছিলেন তাই পরবর্তীতে ডারউইনবাদ নামে পরিচিত হয়েছে। এ মতবাদের ভিত্তি দুটি; যথা- (১) জীবজগতের কতগুলো বাস্তব ঘটনা পর্যবেক্ষণ এবং (২) এ বাস্তব ঘটনাবলীর ফলাফল প্রকাশ। ভিত্তিমূল-দুটির উপর প্রতিষ্ঠিত ডারউইনবাদ বিবর্তন প্রক্রিয়াকে ৬টি ধাপে ভাগ করেছে। মৌলিক সিন্ধান্তগুলো হলো-
জীবন সংগ্রাম
১. বংশ বৃদ্ধির উচ্চহার (Prodigality of production)
২. খাদ্য ও বাসস্থানের সীমাবদ্ধতা (Limitation for food and space)
যোগ্যতমের জয়
৩. জীবন সংগ্রাম (Struggle for existence)
৪. পরিবৃত্তির অসীম ক্ষমতা (Omnipotence of variation amongst the individual) -
নতুন প্রজাতির উৎপত্তি
৫. যোগ্যতমের জয় (Survival of the fittest)
৬. প্রাকৃতিক নির্বাচন (Natural selection)
১। বংশ বৃদ্ধির উচ্চহার : প্রাণী, উদ্ভিদ নির্বিশেষে জ্যামিতিক হারে বংশবৃদ্ধির প্রবণতা দেখায়। ফলে বাঁচার সম্ভাবনা সম্পন্ন জীবের সংখ্যার চেয়ে জন্মানোর সংখ্যা দাঁড়ায় বহুগুণ বেশি। উদাহরণস্বরূপ-একটি স্যামন মাছ এক ঋতুতেই দুই কোটি আশি লক্ষ ডিম পাড়ে। সমস্ত ডিম যদি পূর্ণাঙ্গ প্রাণীতে পরিণত হয় এবং অনুরূপভাবে ডিম পাড়ে তবে দেখা যাবে, পৃথিবীর জলভাগ কয়েক বছরের মধ্যে কেবল এক প্রজাতির প্রাণী দিয়েই পূর্ণ হয়ে যাবে।
২। খাদ্য ও বাসস্থানের সীমাবদ্ধতা : প্রাকৃতিক খাদ্যবস্তুর উৎপাদন হার এবং ভূ-পৃষ্ঠের আয়তন সীমিত। এ অবস্থায় জীবের জ্যামিতিক হারে বংশবৃদ্ধির ফলে এদের ভেতর পর্যাপ্ত আহার ও যোগ্য বাসস্থানের জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হবে অর্থাৎ এরা প্রাকৃতিক বাধার সম্মুখীন হবে।
৩। জীবন সংগ্রামঃ ডারউইনের মতে, প্রাকৃতিক বাধা কার্যকর হয় জীবন সংগ্রামের মাধ্যমে। একদিকে ক্রমাগত বংশবৃদ্ধি অন্যদিকে পরিমিত খাদ্য ও বাসস্থানের যোগান জীবনকে প্রবল প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দেয়। এতে বেঁচে থাকার উপযুক্ত জীব বাছাই হয়ে যায়। এটিই জীবন সংগ্রাম বা অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম। জীবন সংগ্রাম প্রধানত অন্তঃপ্রজাতির সংগ্রাম, আন্তঃপ্রজাতিক সংগ্রাম এবং পরিবেশিক সংগ্রাম তিনভাবে সংঘটিত হয়ে থাকে।
৪। পরিবৃত্তির অসীম ক্ষমতা : জীবিত বংশধরদের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে তেমন কোন পার্থক্য দেখা না গেলেও প্রত্যেকের মধ্যেই কিছু না কিছু পার্থক্য অবশ্যই থাকে। পৃথিবীতে যে কোন দুটি জীব কখনই অবিকল এক রকম হতে পারে না। এ পার্থক্যকে পরিবৃত্তি বা প্রকরণ বলে। ডারউইন মনে করতেন যে, অবিরত সংগ্রামের ফলে জীবদেহে যে প্রকরণ বা পার্থক্যের সৃষ্টি হয় তা প্রজননকালে বংশধরদের দেহে সঞ্চারিত হয়ে পরিশেষে জীবের বৈশিষ্ট্যরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর ধারণা অনুযায়ী, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধারাবাহিক পরিবর্তন ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির উত্তরের জন্য দায়ী।
৫। যোগ্যতমের জয় : জীবন সংগ্রামে লিপ্ত জীবগোষ্ঠীর মধ্যে যারা পরিস্থিতির উপযুক্ত মোকাবিলা করতে পারে শুধু তারাই বেঁচে থাকবে। এসব জীবদেহে স্বভাবতই দেখা দেয় অনুকূল প্রকরণ (favourable variation) যা প্রতিকূল পরিবেশেও জীবকে মানিয়ে নিতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। অন্যদিকে প্রতিকূল প্রকরণ সম্পন্ন জীব পরিবেশের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে কো পেরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এভাবে জীবন সংগ্রামে লিপ্ত জীবদের মধ্যে যোগ্যতমের উদবর্তন করে।
৬। যোগ্যতমের জয় : যে সব জীবের মধ্যে অনুকূল পরিবৃত্তি আছে প্রকৃতি তাদের নির্বাচন ও লালন করে। সুবিধাজনক পরিবৃত্তিধারী জীব পরিবেশের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে এবং অযোগ্যদের তুলনায় বেশি হারে বংশবিস্তার করতে পারে। এরেদ বংশধরদের মদ্যে পরিবত্তিগুলো উত্তরাধিকার সূত্রে পরিবাহিত হয়। যাদের সুবিধাজনক পরিবৃত্তি বেশি থাকে প্রকৃতি পুনরায় তাদের নির্বাচন করে। এভাবে যুদ-যুগান্তর দরে প্রকৃতি কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে প্রাণী ও উদ্ভিদের নতুন নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়।
বিবর্তনের স্বপক্ষে প্রমান গুলো বিভিন্ন শাখায় আলোচনা করা হলো।
• অঙ্গসংস্থানিক প্রমাণ
• ভ্ৰূণতত্ত্বীয় প্রমাণ
• জীবাশ্মঘটিত প্রমাণ
• ভূতাত্ত্বিক কালক্রম
• শ্রেণিবিন্যাস নির্দেশিত প্রমাণ
• শারীরবৃত্তীয় প্রমাণ-
• কোষতাত্ত্বিক প্রমাণ
• জিনতাত্ত্বিক প্রমাণ
• জীবভৌগোলিক প্রমাণ
অঙ্গসংস্থান (morphology) জীববিজ্ঞানের এমন একটি শাখা যাতে জীবের গঠন ও আকৃতি (বাহ্যিক বা অভ্যন্তরীণ) সম্বন্ধে আলোচিত হয়। বিভিন্ন মেরুদণ্ডী প্রাণীর বাহ্যিক ও অন্তর্গঠন পর্যালোচনা করলে সুস্পষ্ট মনে হবে নিম্নশ্রেণির প্রাণী থেকে উচ্চশ্রেণির প্রাণিদেহে অঙ্গসংস্থানজনিত জটিলতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অঙ্গসংস্থানিক প্রমাণকে নিম্নোক্ত কয়েকটি শিরোনামে আলোচনা করা যায়।
ক. তুলনামূলক শারীরস্থান (Comparative Anatomy):
মেরুদন্ডী প্রাণিদের হৃৎপিন্ডের প্রকোষ্ঠ : বিভিন্ন মেরুদন্ডী প্রাণীর হৃৎপিন্ডের গঠনের তুলনামূলক আলোচনা করলে দেখা যায়, মাছে দুইপ্রকোষ্ঠ-বিশিষ্ট হৃৎপিণ্ড উিভচরে তিন প্রকোষ্ঠ-বিশিষ্ট, সরিসৃপে আংশিক চারপ্রকোষ্ঠ-বিশিষ্ট হলেও পাখি ও স্তন্যপায়ীতে সম্পূর্ণ চারপ্রকোষ্ঠ-বিশিষ্ট হৃৎপিন্ড বিদ্যমান।
মেরুদন্ডী প্রাণীদের মস্তিষ্ক : বিভিন্ন শ্রেণির মেরুদন্ডী প্রাণীর মস্তিষ্কের গঠন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, মাছ থেকে শুরু করে স্তন্যপায়ী প্রাণীর মস্তিষ্ক পাঁচটি ভাগে বিভক্ত । বিবর্তনের সোপানে যতই উপর দিকে উঠা যায়, ততই অপেক্ষাকৃত সরল গঠনের মূল কাঠামোটির ক্রমিক জটিলতা দেখা যায়, বিশেষ করে সেরেব্রাল হেমিস্ফিয়ার (cerebral hemisphere) এবং সেরেবেলাম (cerebellum)-এর।
খ. সমসংস্থ অঙ্গ (Homologous Organs)
বিভিন্ন প্রাণীর যে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ উৎপত্তি-র দিক থেকে সদৃশ্য তাদের সমসংস্থ অঙ্গ বলে তিমির অগ্রপদ, বাদুর ও পাখির ডানা, কুকুরের অগ্রপদ মানুষের হাত আপাতঃদৃষ্টিতে একে অপর থেকে ভিন্ন বলে মনে হয়। কিন্তু এদের পরীক্ষা করলে একই রকমের মৌলিক কাঠামো পরিলক্ষিত হবে। জীবনধারণ পদ্ধতির ভিন্নতার কারণে আকৃতি ও প্রকৃতি ভিন্ন হয়েছে।
গ. নিষ্ক্রিয় অঙ্গসমূহ (Vestigeal Organs)
প্রচলিত ধারণায়,(যে সব অঙ্গ একসময় পূর্বপুরুষের দেহে সুগঠিত ও কার্যক্ষম ছিল, কিন্তু পরবর্তী বংশধরের দেহে গুরুত্বহীন, অগঠিত এবং অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে সেগুলোকে নিষ্ক্রিয় অঙ্গ বলে। মানবদেহে শতাধিক নিষ্ক্রিয় অঙ্গের সন্ধান পাওয়া গেছে। যেমন -
(i) চোখের ভেতরেরদিকের কোণায় উপপল্লব (nictitating membrane),
(ii) আক্কেল দাঁতসহ কয়েক ধরনের দাঁত;
(iii) গায়ের লোম;
(iv) বহিঃকর্ণের তিনটি করে কর্ণপেশি;
(v) লেজ না থাকলেও পুচ্ছাস্থি;
(vi) বৃহদান্ত্রের সাথে যুক্ত অ্যাপেন্ডিক্স ইত্যাদি ।
বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীতে এদের সক্রিয় ভূমিকা এখনও দৃষ্ট হয়। গরু কান নাড়াতে পারে কিন্তু মানুষ তা পারে না। মানুষের লেজের কশেরুকাগুলো একত্রিত হয়ে ছোট অস্থি পিণ্ড বা কক্কিক্স হিসেবে মেরুদণ্ডের পশ্চাৎপ্রান্তে এখনও অবস্থান করছে। পরিবেশগত কারণে মানুষে এসব অঙ্গগুলো প্রয়োজনে না আসায় বিবর্তনের মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় অঙ্গে রূপান্তরিত হয়েছে।
ভ্রুণতত্ত্বীয় প্রমাণ (Embryological Evidences): ভূগতত্ত্ব, তুলনামূলক ভ্রুণতত্ত্ব এবং পরীক্ষামূলক ভ্রণতত্ত্ব জৈব বিবর্তনের অন্যতম প্রত্যক্ষ প্রমাণ বলে অনেকে মনে করেন। প্রতিটি বহুকোষী প্রাণী একটি জাইগোট (একটি একক কোষ) থেকে পরিস্ফুটিত হয়। জাইগোটের বিভাজন, মানুষসহ সকল বহুকোষীতেই মূলত এক রকম। যে সব পূর্ণাঙ্গ প্রাণী গঠনগত সম্বন্ধপরতায় আবদ্ধ তাদের পরিস্ফুটন পদ্ধতিও সদৃশ। পরে বিভিন্ন গোষ্ঠীতে পরিস্ফুটনরীতি বিভিন্ন রূপ নেয়। এ বিভিন্নতা অনেকটা গাছের শাখা-প্রশাখা বিস্তারের মতো অগ্রসর হতে থাকে।
মাছ, উভচর, সরিসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ীর ভূণগুলোকে প্রথম অবস্থায় পরস্পর থেকে প্রায় পৃথকই। করা যায় না। পরিস্ফুটনের পরবর্তী পর্যায়ে প্রত্যেক শ্রেণির বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো প্রকাশিত হয়।
ভূণের এই সাদৃশ্য লক্ষ করে জার্মান বিজ্ঞানী কার্ল ভন বেয়ার (Karl von Baer, ১৮১৮) বলেছেন যে ভূণাবস্থায় একটি জীব আদি ইতিহাসকে সংক্ষিপ্তাকারে প্রকাশ করে থাকে। তাঁর মতে-
*বিশেষ বৈশিষ্ট্য আবির্ভাবের আগে সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহের উত্তর ঘটে;
*সাধারণ বৈশিষ্ট্য থেকে অবশেষে বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো উদ্ভূত হয়;
*ভ্রুণাবস্থায় একটি প্রাণী তাড়াতাড়ি অন্যান্য প্রাণীর গঠন আগ করে এবং
*একটি শিশু প্রাণীকে তার নিম্নস্তরের প্রাণিগোষ্ঠীর পূর্ণাঙ্গ দশার মতো নয় বরং শিশু বা ভ্রূণীয় দশার মতো দেখায় ।
অতএব বলা যায় যে, সকল মেরুদণ্ডী প্রাণী একই পূর্বপুরুষ থেকে সৃষ্টি হয়ে পরে বিভিন্নভাবে বিকশিত হয়েছে। পরবর্তীকালে হেকেল (Haeckel) ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে বিভিন্ন প্রাণীর জীবন-ইতিহাস এবং ভ্রূণের পরিস্ফুটন পর্যবেক্ষণ করে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হন তাকে পুনরাবৃত্তি মতবাদ (Recapitulation Theory) নামে আখ্যায়িত। করা হয়। এ মতবাদ অনুযায়ী, ব্যক্তিজনি জাতিজনির পুনরাবৃত্তি করে।
অথ্যাৎ,কোন একটি জীবের ভ্রূণের পরিস্ফুটনকালে তার পুর্বপুরুষের ক্রমবিকাশের ঘটনাবলি পুনরাবৃত্তি করে।
আদি শিলাস্তরে প্রস্তরীভূত অথবা পাললিক শিলাস্তর (sedimentary rock)-এ প্রাকৃতিক উপায়ে সংরক্ষিত প্রগৈতিহাসিক (বিলুপ্ত) জীবের দেহ, দেহাংশ বা দেহের কোন অংশের ছাপ কিংবা রাসায়নিক পদার্থে সৃষ্ট জীবদেহের কাঠামোকে জীবাশ্ম (fossil; ল্যাটিন শব্দ fossilumn = মাটির নিচ থেকে খনন করে পাওয়া কোন বস্তু) বলা হয়। জীববিজ্ঞানের (যে শাখায় জীবাশ্ম নিয়ে গবেষণা ও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলোচিত হয় তাকে জীবাশ্মবিজ্ঞান বা প্যালিওন্টোলজি (Palacontalogy) বলে । অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও জীবাশ্মগুলো অধুনালুপ্ত প্রাচীন উদ্ভিদ ও প্রাণী সম্পর্কে সর্বাপেক্ষা সুদৃঢ় সাক্ষ্য বহন করে এবং এদের ক্রমিক পরিবর্তন নির্দেশ করে। বিবর্তনের সপক্ষে জীবাশ্মঘটিত কয়েকটি প্রমাণ নিচে উপস্থাপিত হলো ।
ক. ঘোড়ার বিবর্তনের ধারা : জীবাশ্ম ইতিহাস থেকে জানা যায় যে ঘোড়ার বিবর্তনে অন্ততঃ ১২টি গণ ও কয়েকশ জাতির উৎপত্তি ও বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে অবশেষে বর্তমান গণভুক্ত Equus প্রজাতির ঘোড়ার উৎপত্তি হয়েছে। চলন ও খাদ্যাভ্যাসজনিত অভিযোজন ঘোড়ার বিবর্তনকে প্রভাবিত করেছে। জীবাশ্ম ইতিহাসে পরিবর্তনশীল পরিবেশে ঘোড়ার অভিযোজনের বিষয়টি বিজ্ঞানীদের কাছে স্পষ্ট বলে জানা গেছে। দেহের আকার, তৃতীয় আঙ্গুল, দাঁত ও দাঁতের চূড়া প্রভৃতির বৃদ্ধি; পা-গুলোর লম্বা হওয়া; পার্শ্বীয় আঙ্গুলগুলোর খাটো হওয়া; পিঠ সোজা হওয়া প্রভৃতি উপাদান ঘোড়ার বিবর্তনে প্রভাব বিস্তার করেছে। প্রায় ৬ কোটি বছর আগে ১৫ ইঞ্চি (0.4m) উঁচু Eohippus-এর উৎপত্তির মধ্য দিয়ে যে বিবর্তন শুরু হয়েছিল তার আপাত সমাপ্তি হয়েছে ৬৩ ইঞ্চি (1.6m) উচ্চতা সম্পন্ন Equus উৎপত্তির মাধ্যমে ।
খ. সংযোগকারী যোগসূত্র (Connecting Link) : (দুটি নিকটবর্তী পর্ব বা শ্রেণির মধ্যবর্তী দশার জীবাশ্মকে সংযোগকারী যোগসূত্র বলে । archaeopteryx (আর্কিওপটেরিক্স) এ ধরনের একটি জীবাশ্ম। আজ থেকে ১৪ কোটি ৭০ লক্ষ বছর আগে জুরাসিক যুগে এর আবির্ভাব হয়েছিল। এর ধ্বংশবশেষ জার্মানীর বেডেরিয়ার বিখ্যতি সোলেন হোপেন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়। এতে রয়েছে পাখি এবং সরিসৃপ উভয় শ্রেণি (class)-র বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য করা যায়। সে কারণে Archaeopteryx-কে সরিসৃপ থেকে পাখি উদ্ভবের এক পর্যায় বা সংযোগকারী যোগসূত্র বলে মনে
করা হয়।
Archaeopteryx-এ সরিসৃপীয় বৈশিষ্ট্য-
১. শুষ্ক আঁইশযুক্ত দেহ ও দাঁতযুক্ত চোয়াল ।
২. লম্বা শরীর ও ২০টি কশেরুকা নিয়ে গঠিত লম্বা লেজ।
৩. পুরু ও ভারী হাড়; ডানার অগ্রভাগে নখর।
Archaeopteryx-এ পাখির বৈশিষ্ট্য-
১. দেহ পালকে আবৃত, দেখতে পাখির মতো।
২. চোয়াল পাখির চঞ্চুর মতো লম্বা।
৩. হাড়ের সংস্থাপন পাখির মতো এবং ডানা বিদ্যমান।
Archaeopteryx এর জীবাশ্ম সরিসৃপ থেকে পাখিতে রুপান্তরিত হওয়ার প্রমাণ বহন করে। একারণে বলা হয় Birds are Glorified Reptile (পাখি একটি মহিমান্বিত সরিসৃপ)।
গ. জীবন্ত জীবাশ্ম (Living Fossil) : যে সব প্রাণী সুদূর অতীতে উৎপত্তি লাভ করে আজও অঙ্গসংস্থানিক ও শারীরবৃত্তীয় কাজের অপরিবর্তিত রূপ নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে আছে অথচ এদের সমসাময়িক ও সমগোত্রীয় সকলেরই বহু পূর্বে বিলুপ্তি ঘটেছে এবং যারা পর্ব থেকে পর্বের বা শ্রেণি থেকে শ্রেণির উদ্ভবের নিদর্শন বহন করে চলেছে তাদেরকে জীবন্ত জীবাশ্ম বা লিভিং ফসিল বলে। Platypus (প্লাটিপাস) এ ধরনের একটি জীবন্ত জীবাশ্ম। এর কিছু বৈশিষ্ট্য (যেমন-ডিম, রেচন-জননতন্ত্র) সরিসৃপ শ্রেণির মতো, আবার কিছু বৈশিষ্ট্য (যেমন- স্তনগ্রন্থি, লোম) স্তন্যপায়ীর মতো। এছাড়াও Limulus, Peripatus, Sphenodon, Latimaria-ও জীবন্ত জীবাশ্ম।
শ্রেণিবিন্যাস নির্দেশিত প্রমাণ (Taxonomical Evidencences): সমগ্র জীবজগতকে প্রধানত প্রাণী ও উদ্ভিদ-জগতে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো আবার পর্ব (Phylum), শ্রেণি (Class), বর্গ (Order), গণ (Genus), প্ৰজাতি (Species) ইত্যাদি উপবিভাগে বিভক্ত। এ ভাগগুলো খেয়াল খুশীমত করা হয়নি। ভাগগুলো প্রকৃতই সম্পর্ক নির্ভর। একই রকম বৈশিষ্ট্যযুক্ত প্রাণিদের একটি প্রজাতিভুক্ত করা হয়। একই ধরনের অনেক প্রজাতি মিলে একটি "গণ”, কয়েকটি গণের সমষ্টি একটি “বর্গ”, অনেক বর্গের সমষ্টি মিলে একটি “শ্রেণি” এবং কয়েকটি শ্রেণি মিলে “পর্ব” এবং কয়েকটি "পর্ব” একত্র করে প্রাণিদের ক্ষেত্রে “প্রাণিজগত” এবং উদ্ভিদের ক্ষেত্র “উদ্ভিদজগত” সৃষ্টি করা হয়েছে। বিবর্তনবিজ্ঞানীদের ধারনা জীবজগতে বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে বৈশিষ্ট্যসমূহের মতার কারণ বৈশিষ্ট্যগুলো একই পূর্বপুরুষ থেকে বংশাধিকার সূত্রে পাওয়া।
শারীরবৃত্তীয় ও জীবরসায়নঘটিত প্রমাণ (Physiological and Biochemical Evidences):
নিচুশ্রেণির প্রাণীর জৈবনিক প্রক্রিয়া উঁচু শ্রেণির প্রাণীর মত জটিল নয়। তথাপিও একই শ্রেণির প্রাণিদের শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপ বহুলাংশে একই ধরনের। এদের খাদ্যগ্রহণ, খাদ্য পরিপাক, রেচন, শ্বসন প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে অনেক সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়।
জীব রাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, সকল প্রাণী ও উদ্ভিদের একই ধরনের কতকগুলো জৈবিক উপাদান বিদ্যমান। যেমন- আমিষ, নিউক্লিক এসিড, এনজাইম, হরমোন ইত্যাদি। এসব উপাদানগুলোর আণবিক গঠনগত মিলগুলোও লক্ষণীয় । আদিতম জীব থেকে জাটিলতম জীবে এসব উপাদানের উপস্থিতিই বিতর্তনের প্রমাণ বহন করে।
কোষতাত্ত্বিক প্রমাণ (Cytological Evidences):
উদ্ভিদ ও প্রাণীর কোষের মৌলিক গঠন ও বিভাজন পদ্ধতি প্রায় একই রকম। আণবিক পর্যায়ে সজীব কোষ অঙ্গাণুগুলো, যেমন-মাইটোকন্ড্রিয়া, রাইবোজোম, লাইসোজোম, গলজিবস্তু, ক্রোমোজোম প্রভৃতির গঠন প্রায় সদৃশ। তাই বলা যায়, উদ্ভিদ ও প্রাণী একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
জিনতাত্ত্বিক প্রমাণ (Genetical Evidences):
বিভিন্ন জীবের মধ্যে সমতা ও বৈষম্যের কারণ যে জিনগত গড়ন (genetic consitution) তা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত। জিনগত এ বৈশিষ্ট্যই বিবর্তনের ভিত্তি এবং কীভাবে এটি পরিবর্তিত হয়ে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয় তাও বিজ্ঞানীদের কাছে আর অজানা নয় । Drosophila (ড্রসোফিলা)-র বিভিন্ন প্রজাতির ক্রোমোজোমগত বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে তাদের পূর্বপুরুষ নির্ধারণ করা যায় এবং এ সত্যই প্রকাশিত হয় যে ওরা একই পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্য উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করছে।
জীব ভৌগোলিক প্রমাণ (Evidence from Geographical Distribution): প্রাণিদের বিস্তারের উপর ভিত্তি করে আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস ( Alfred Russel Wallace) ১৮৭০ সালে পৃথিবীকে ৬টি অঞ্চলে ভাগ করেছেন। একটি অঞ্চলের জীবের সাথে অন্যটির সাদৃস্য খুব কমই। জীবের এমন ভৌগোলিক বিস্তার অভিব্যক্তিরই ধারা নির্দেশ করে। একমাত্র অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে প্রাপ্ত মারসুপিয়াল (marsupial) স্তন্যপায়ীদের উপস্থিতি ও অতীত বিস্তারকে বিবর্তনের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা যায়। ভূত্তাত্ত্বিক তথ্য থেকে জানা গেছে যে, অস্ট্রেলিয়া অন্যান্য ভূখণ্ড থেকে এমন এক সময় আলাদা হয়ে গিয়েছিল যখন মারসুপিয়ালরা পৃথিবীর অনেকাংশে বিস্তৃত ছিল এবং তখনও অমরাধর (placental) স্তন্যপায়ীদের উদ্ভব ঘটেনি। সম্পূর্ণ আলাদা হওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ায় সম্ভবত গুটিকয়েক ধরনের আদি স্তন্যপায়ী বাস করত। মূল ভূখন্ডে তখন অমরাধর স্তন্যপায়ীদের আবির্ভাবের ফলে আদি প্রাণীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরাজিত ও বিলুপ্ত হয়ে যায় । অমরাধর প্রাণী অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশ করতে না পারায় মারসুপিয়ালরা বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় বিভিন্নভাবে বিবর্তিত হওয়ায় সুযোগ পেয়ে পরিবেশের প্রতিটি অংশে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করতে সক্ষম হয়েছে।
অসম্পূর্ণ প্রকটতা (Incomplete Dominance): ফলাফল ১ : ২ : ১
যখন একজোড়া বিপরীত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দুটি জীবে সংকরায়ন (ক্রস) ঘটে কিন্তু প্রথম বংশধরে (F1 জনুতে) প্রকট ফিনোটাইপ পূর্ণ প্রকাশে ব্যর্থ হয় এবং উভয় বৈশিষ্ট্যের মাঝামাঝি এক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটে তখন তাকে অসম্পূর্ণ প্রকটতা বলে। অসম্পূর্ণ প্রকটতার জন্য দায়ী জিনগুলোকে ইন্টারমিডিয়েট জিন (intermediate gene) বলে। অসম্পূর্ণ প্রকটতার কারণে মেন্ডেলের মনোহাইব্রিড ক্রসের অনুপাত ৩ : ১ এর পরিবর্তে ১: ২ : ১ হয়।
জিনতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা (Genetic explanation):
ধরা যাক- ফুলের লাল বর্ণের প্রতীক = R, সাদা বর্ণের প্রতীক = r
ব্যাখ্যা: এখানে লাল ফুলের জন্য RR এবং সাদা ফুলের জন্য rr জিন দেখানো হয়েছে । R-এর সম্পূর্ণ প্রকটতা থাকলে উদ্ভিদের ফুল লাল রং-এর হতো এবং বংশধরের ফিনোটাইপিক অনুপাত হতো ৩ : ১। কিন্তু R-এর অসম্পূর্ণ প্রকটতার কারণেই
হেটারোজাইগাস (Rr)- এর বর্ণ গোলাপী (Pink) এবং বংশধরে ১ : ২ : ১ ফিনোটাইপিক অনুপাতের (লাল, গোলাপী, সাদা) সৃষ্টি হয়েছে।